ঢাকা : পথের শেষে দাঁড়িয়ে দুই দল স্পেন ও ইংল্যান্ড। ফুটবলপ্রেমীরাও অধীর আগ্রহে বার্লিনের মহারণের দিকে তাকিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে। অনেকেই দুর্বার স্পেনের পক্ষে, স্বরূপে ফেরার আভাস দেওয়া ইংল্যান্ডের পক্ষেও বাজি ধরার লোক কম নয়। জয়ী হবে কে? কার হাতে উঠবে ইউরোপ সেরার রাজদণ্ড?
অলিম্পিক স্টেডিয়ামে রোববারের ফাইনালে মিলে যাবে উত্তর। জার্মানির সাথে যৌথভাবে তিন ইউরো জয়ের রেকর্ড স্পেন নিজেদের করে নিতে পারবে কিনা; নাকি আন্তর্জাতিক আঙিনায় দীর্ঘদিন শিরোপা বুভুক্ষ ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো পাবে ইউরো জয়ের অনির্বচনীয় স্বাদ, সে মীমাংসাও হয়ে যাবে একদিন পরই।
[227545]
এ মুহূর্তে অনেক আলোচনার ভিড়ে এই প্রশ্নও আছে- ফাইনালের মহারণে এগিয়ে কে? ফাইনাল পর্যন্ত পথচলায় স্পেনের শিকারগুলো দেখলে লুইস দে লা ফুয়েন্তের দলের পক্ষে ভোট বেশি পড়ার কথা। টানা ছয় জয়ের পথে ‘লা রোজা’রা গ্রুপ পর্বে হারিয়েছে শিরোপাধারী ইতালি, ২০১৮ বিশ্বকাপের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া ও আলবেনিয়াকে।
নকআউট পর্বে তারা বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছে রক্ষণে দৃঢ়তা দেখিয়ে দারুণ খেলা জর্জিয়ার, ইউরোর স্বাগতিক জার্মানির এবং সবশেষ সেমি-ফাইনালে গত বিশ্বকাপ রানার্সআপ ফ্রান্সের। মোদ্দা কথা, এবারের আসরে ফেভারিটের তালিকায় থাকা প্রায় সব দলকেই হারিয়েছে স্প্যানিশরা। শেষ লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ আরেক ‘ফেভারিট’ ইংল্যান্ড।
গ্যারেথ সাউথগেটের দলের শিকারের তালিকায় অবশ্য বাঘা নাম নেই খুব বেশি। গ্রুপ পর্বে বরং তারা ছিল বিবর্ণ। সার্বিয়াকে হারিয়ে শুরুর পর ডেনমার্ক ও স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে ড্র করে গ্রুপ পর্ব পেরিয়েছিল ইংলিশরা।
নকআউটেও ‘থ্রি লায়ন্স’দের গর্জন শোনা যায়নি সেভাবে। শেষ ষোলো থেকে ছিটকে যাওয়ার প্রবল চোখ রাঙানি ছিল, কিন্তু যোগ করা সময়ে জুড বেলিংহ্যাম সমতার স্বস্তি এনে দেওয়ার পর হ্যারি কেইনের অতিরিক্ত সময়ের গোলে প্রাণ ফিরে পায় তারা। পার হয় স্লোভাকিয়া বাধা।
এরপর কোয়ার্টার-ফাইনালে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ঘাম ঝরানো ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে জয়, সেমি-ফাইনালে পিছিয়ে পড়ার পর ওলি ওয়াটকিন্সের শেষ দিকের গোলে জেতে ইংল্যান্ড। কষ্টে বৈতরণীগুলো পার হওয়া ইংল্যান্ডকে নিয়ে চারপাশে ধুন্ধুমার সমালোচনা চললেও দলটি দ্রুত উন্নতির ইঙ্গিতও দিয়েছে নকআউটে এসে। তাছাড়া টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইউরোর ফাইনালে আসায় সাউথগেটের দল পাচ্ছে আলাদা সমীহ।
[227540]
তবে সবদিক থেকেই এগিয়ে স্পেন। কোয়ার্টার-ফাইনাল বাদে বাকি পাঁচ ম্যাচ তারা জিতেছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। এই পথচলায় গোল করেছে ১৩টি। আক্রমণভাগে আছে লামিনে ইয়ামালের মতো এক বিস্ময়বালক। ফ্রান্স ম্যাচে ২৫ গজ দূর থেকে চোখ জুড়ানো বাঁকানো শটে লক্ষ্যভেদ করে ১৬ বছর বয়সী এই তরুণ দেখিয়েছেন তার পায়ে জাদু আছে। তবে নান্দনিকতা ও আগ্রাসী ফুটবলের মিশলে স্পেনের খেলা জাদুকরী ফুটবলের মূল মন্ত্র দলীয় প্রচেষ্টা।
ইংল্যান্ড আসরে সেভাবে এখনও ‘একটা দল’ হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে, তিন বছর আগের ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে টাইব্রেকারে তাদের হেরে যাওয়ার সেই দুঃসহ স্মৃতির পুনরাবৃত্তির শঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
বড় মঞ্চে সাফল্যের জন্য অপেক্ষা অবশ্য চলছে দুই দলেরই। অবশ্য সময়ের হিসেবে দুই দলের অপেক্ষাতেও বিস্তর ফারাক।
১৯৬৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর আজও বড় শিরোপার স্বাদ পায়নি ইংল্যান্ড। গত ইউরোতে ট্রফির ঘ্রাণ পেলেও নিজেদের ডেরায় ‘থ্রি লায়ন্স’রা শিকার করতে পারেনি ইতালিকে।
২০২৩ উয়েফা নেশন্স লিগের শিরোপা জেতা স্পেন সবশেষ ইউরোর মুকুট পরেছিল ২০১২ সালে। তার দুই বছর আগে পেয়েছিল বিশ্বকাপ জয়ের অপূর্ব স্বাদ। বড় মঞ্চে সুদিন ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় তারাও।
অপেক্ষায় দুই কোচ সাউথগেট ও দে লা ফুয়েন্তেও। গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে মরক্কোর কাছে হেরে স্পেন ছিটকে যাওয়ার পর দলটির হাল ধরেন দে লা ফুয়েন্তে। ‘হাই প্রোফাইল’ কোচ নন তিনি, কিন্তু এরই মধ্যে দলের খোলনলচে দিয়েছেন পাল্টে। ভারসাম্য এনে, শৈল্পিকতার সাথে আগ্রাসনের মিশেল ঘটিয়ে দুর্বার করে তুলেছেন দলকে।
ইয়ামালের মতো অসাধারণ এবং সঙ্গে নিকো উইলিয়ামসের মতো ক্ষিপ্র গতির দুই উইঙ্গার, ফাবিয়ান রুইসের মতো দুর্দান্ত মিডফিল্ডার আছে দে লা ফুয়েন্তের হাতে। গোল পাওয়ার ধারাবাহিকতায় থাকা দানি ওলমোর উপস্থিতি তার আক্রমণভাগকে করেছে আরও শক্তিশালী। কার্ডের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দানি কারভাহাল ও হবাঁন লু নহমাঁর ফেরা তার স্বস্তি বাড়াচ্ছে আরও।
বিপরীতে ইংল্যান্ডের আক্রমণভাগই এখনও ঠিকঠাক জমেনি। জুড বেলিংহ্যাম ও ফিল ফোডেনের অনেক ম্যাচ জয়ের অভিজ্ঞতা আছে বটে, কিন্তু জাতীয় দলের রেকর্ড গোলদাতা হ্যারি কেইনের সঙ্গে জমছে না। যদিও চলতি ইউরোয় তিন গোল করেছেন কেইন, কিন্তু ৩০ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড নেই ফর্মের তুঙ্গে; বরং ধুঁকছেন। দলটির কোচের মতো সমর্থকদেরও চাওয়া, প্রয়োজনের সময়ে জ্বলে উঠবেন কেইন।
রক্ষণে অবশ্য ইংল্যান্ডের দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। ম্যাচ প্রতি গড়ে ৯.৫ হারে প্রতিপক্ষকে শট নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে তারা; এবারের ইউরোতে যেটা কোনো দলের রক্ষণের সেরা পারফরম্যান্স। চোট কাটিয়ে লুক শ’য়ের ফেরাও সাউথগেটের জন্য স্বস্তির। বার্লিনে শুরুর একাদশে থাকতে পারেন শ। রাইট-ব্যাকে সংগ্রাম করা কাইল ওয়াকারও সেমি-ফাইনালে ডাচ ফরোয়ার্ড কোডি হাকপোকে আটকে ইঙ্গিত দিয়েছেন নিজেকে ফিরে পাওয়ার।
সব মিলিয়ে দুই দলকেই সব রসদ নিয়ে ঝাঁপাতে হবে বার্লিনে। কেননা, দুই দলের সবশেষ মুখোমুখি লড়াই দেখাচ্ছে, মোড় ঘুরতে সময় নেয় না। প্রায় ছয় বছর আগে ভালেন্সিয়ায় মুখোমুখি হয়েছিল স্পেন ও ইংল্যান্ড। প্রথমার্ধেই ৩-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল ইংলিশরা। দ্বিতীয়ার্ধে দারুণভাবে ম্যাচ জমিয়ে তুলে স্পেন হেরেছিল ৩-২ ব্যবধানে। বার্লিনে পাঁচ গোলের রোমাঞ্চ ছড়াবে কিনা, কে জানে, তবে রোমাঞ্চকর ম্যাচের আশা করতেই পারেন ফুটবলপ্রেমীরা।
এমটিআই