ঢাকা: টেস্টে সর্বশেষ ১০ ইনিংসে রোহিত শর্মার রান ১৩৩, বিরাট কোহলির ১৯২। দুজনেরই ফিফটি মাত্র একটি করে। ভারত জিতলে না হয় ব্যাট হাতে রোহিত-কোহলির ছন্দহীনতা কিছুটা হলেও আড়ালে পড়ে যেত।
কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের মাটিতে ভারত যেভাবে অপদস্থ হলো, তাতে দুজনের সাম্প্রতিক ব্যাটিং পরিসংখ্যান আরও বেশি করে সামনে আসছে। তা দেখার পর তাদের টেস্ট দল থেকে বাদ দেওয়ার আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে।
গত ২৫ অক্টোবর নিউজিল্যান্ড সিরিজ চলার সময়ই অস্ট্রেলিয়া সফরে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির স্কোয়াড ঘোষণা করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। যথারীতি সেই সিরিজেও নেতৃত্ব দেবেন রোহিত। আছেন কোহলি, রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজাও। অশ্বিনের বয়স ৩৮ পেরিয়েছে, রোহিতের পেরিয়েছে ৩৭। আগামীকাল কোহলি ৩৬তম জন্মদিনের কেক কাটবেন। ডিসেম্বরে জাদেজারও ৩৬ পূর্ণ হবে। খুব সম্ভবত এটাই ৪ সিনিয়র ক্রিকেটারের একসঙ্গে শেষ অস্ট্রেলিয়া সফর হতে যাচ্ছে।
তবে এই সফরে যদি রোহিত, কোহলি, অশ্বিন ও জাদেজা ব্যর্থ হন; আরও স্পষ্ট করে বললে ভারত যদি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠতে না পারে, তাহলে ৪ জনেরই টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’ বলছে, সিনিয়রদের ভবিষ্যৎ ঠিক করতে বিসিসিআইয়ের সঙ্গে শিগগিরই আলোচনায় বসতে পারেন প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীর ও প্রধান নির্বাচক অজিত আগারকার।
গতকাল মুম্বাই টেস্ট হেরে নিউজিল্যান্ডের কাছে ৩-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই হয়েছে ভারত। দেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজে ভারতীয়দের ধবলধোলাই হওয়ার মাত্র দ্বিতীয় ঘটনা এটি।
রোহিত-কোহলিরা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের থেকে স্পিন ভালো খেলেন-এমন কথা প্রচলিত থাকলেও এই সিরিজে তা পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ৩ ম্যাচে ভারতের ৬০ উইকেটের ৩৭টিই নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের স্পিনাররা।
ম্যাচে এজাজ প্যাটেল-গ্লেন ফিলিপসদের সামলাতে মুম্বাই টেস্টের আগে ৩৫ জন নেট বোলার ডেকে এনেছিল ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট, এদের মধ্যেই বেশির ভাগই ছিলেন স্পিনার। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টের এই কৌশলও কোনো কাজে আসেনি।
মুম্বাই টেস্টেও ভারতের ২০ উইকেটের ১৬টি নিয়েছেন কিউই স্পিনাররা। দুজন ব্যাটসম্যান হয়েছেন রানআউট; এর একজন কোহলি প্রথম ইনিংসে পাগলাটে দৌড় দিয়ে ব্যক্তিগত ৪ রানে থাকতে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন। আজ দ্বিতীয় ইনিংসে ১ রান করে আউট হয়েছেন এজাজ প্যাটেলের বলে। ১১৮ টেস্টের ক্যারিয়ারে এই প্রথম এক টেস্টের দুই ইনিংসেই এক অঙ্কের ঘরে আউট হয়েছেন।
বাঁহাতি স্পিনারদের বলে কোহলির সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ভারতীয় সমর্থকদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ১২ বার বাঁহাতি স্পিনে উইকেট দিয়ে ফিরেছেন কোহলি। এই সময়ে তাদের বিপক্ষে ব্যাটিং গড় মাত্র ২০.৪১।
সর্বশেষ ৮ ইনিংসেই তিন বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান, মিচেল স্যান্টনার ও এজাজ প্যাটেলের শিকার হয়েছেন ৪ বার। ঘরের মাঠে লাগাতার স্পিন সামলাতে ব্যর্থ হলেও প্রথম শ্রেণির ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি অনীহা দেখিয়ে চলেছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, কোহলি সর্বশেষ রঞ্জি ট্রফিতে খেলেছেন ২০১২ সালের নভেম্বরে, তার আদর্শ শচীন টেন্ডুলকার অবসর নেওয়ারও এক বছর আগে!
মুম্বাই টেস্টের দুই ইনিংসেই ভারতের উইকেট পতনের শুরু হয়েছে অধিনায়ক রোহিতকে দিয়ে। ম্যাচে ভারতের মাত্র ২টি উইকেট গেছে নিউজিল্যান্ডের পেসারদের দখলে। ২টিই নিয়েছেন ম্যাট হেনরি। তবে ব্যাটসম্যান একজনই-রোহিত।
সর্বশেষ ১০ ইনিংসে ৬ বারই এক অঙ্কের ঘরে থাকতে তাকে ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয়েছে। ২০ রানের কম করেছেন দুবার। কোহলি স্পিনে ভুগলেও রোহিতের সমস্যাটা ডানহাতি পেসে। সর্বশেষ ১০ ইনিংসের ৬টিতেই হাসান মাহমুদ, তাসকিন আহমেদ, টিম সাউদি (২ বার) ও ম্যাট হেনরির (২ বার) বলে রোহিত আউট হয়েছেন।
গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে ইনিংসের শুরুতেই মারমুখী হতে দেখা যাচ্ছে রোহিতকে। ওয়ানডের পর টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও এভাবে সফল হয়েছেন।
[236266]
কিন্তু ধৈর্যের খেলা টেস্টেও তিনি একই কৌশলে খেলে যাচ্ছেন। পিচ যেমনই হোক, পরিস্থিতি যেমনই হোক, আক্রমণাত্মক ব্যাটিংকেই যেন অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছেন ‘দ্য হিটম্যান’খ্যাত ব্যাটসম্যান। এ কারণেই ইনিংসগুলো বড় করতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে ভালো বলগুলোতেও বড় শট খেলতে গিয়ে উইকেটে বিলিয়ে দিয়ে আসছেন।
রোহিতের শট নির্বাচন নিয়ে তাই প্রশ্ন তুলেছেন অনিল কুম্বলে। ভারতের সাবেক এই টেস্ট অধিনায়ক ও প্রধান কোচ বলেছেন, ‘রোহিতের শট নির্বাচন ও ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ দেখে আমি কিছুটা বিস্মিত। ইনিংসের শুরুর দিকে ফাস্ট বোলারের ওপর চড়াও হওয়া ইতিবাচক বার্তা দেয় না। যখন এটা কাজে লাগে, শুধু তখনই মুগ্ধতা ছড়ায়। এটা বোঝায় যে পিচ খেলার অযোগ্য এবং এটিই রান করার একমাত্র উপায়।’
এমন হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে রোহিতকেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অধিনায়কত্ব ও ব্যাটিং ভালো হয়নি, সেটা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু টেস্টে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এখন অস্ট্রেলিয়া সফরে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের দিকে মনোযোগ দিতে চান।
নিউজিল্যান্ডের কাছে ৩-০ ব্যবধানে ধবলধোলাই হওয়ার পর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্ট তালিকার দুইয়ে নেমে গেছে ভারত। অন্য দলগুলোর ওপর নির্ভর না করে টানা তৃতীয় চক্রের ফাইনালে উঠতে হলে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে জিততে হবে ভারতকে। সেই সিরিজে যদি রোহিত, কোহলি, অশ্বিন ও জাদেজা ব্যর্থ হন; এরপরও ভারত যদি ভারতে ওঠে, তবু তাদেরকে বাদ দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন বিসিসিআইয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, ‘অবশ্যই পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হবে, যেহেতু দল ১০ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। এরই মধ্যে স্কোয়াড ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পরিবর্তন আনলে একধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
কিন্তু ভারত যদি ইংল্যান্ডে (লর্ডসে) টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠতে না পারে, তাহলে সবচেয়ে সিনিয়র ৪ জনের যুক্তরাজ্যের বিমানে ওঠা না–ও হতে পারে। এমনও হতে পারে, এটাই (মুম্বাই টেস্ট) ঘরের মাঠে ৪ জনের একসঙ্গে শেষ টেস্ট।’
এআর