ঢাকা: পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনিতে একটি ফুটবল ম্যাচে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে শতাধিক সমর্থকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
রেফারির একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত। সমর্থকরা গ্যালারি ছেড়ে মাঠে নেমে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এমনকি সমর্থকদের দিক থেকে রেফারির উদ্দেশে পাথর ছুঁড়েও মারা হয়। এ ঘটনায় শুধু মৃতের সংখ্যাই ‘প্রায় ১০০’!
গিনির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এন’জেরেকোরে সামরিক জান্তাদের নেতা মামাদি দুমবুইয়ার সম্মানে আয়োজিত ফুটবল টুর্নামেন্টে গতকাল একটি ম্যাচের পর সমর্থকদের মধ্যে দাঙ্গায় অনেকে হতাহত হয়েছেন।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হাসপাতালে যত দূর চোখ যায়, শুধু লাশ আর লাশ...প্রায় ১০০ জনের মতো মারা গেছেন।’ আরেকজন চিকিৎসক বলেন, ‘কয়েক ডজন মারা গেছেন।’
ওদিকে জার্মান ফুটবলের চতুর্থ স্তরে কার্ল জেসিস জেনা ও বিএমজি চেমি লাইপজিগের মধ্যকার ম্যাচ শেষে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন দুই দলের সমর্থকেরা। পুলিশ গ্যালারিতে ঢুকে মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত স্প্রে ছড়িয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। ৭৯ জন আহত হওয়ার মধ্যে রয়েছেন ১০ পুলিশ কর্মকর্তা ও ৫ জন নিরাপত্তাকর্মী।
জেনা নিজেদের মাঠে ৫-০ গোলে জেতার পর লাইপজিগ সমর্থকদের বড় একটি অংশ স্বাগতিক সমর্থকদের গ্যালারিতে যেতে ‘সহিংসভাবে (গ্যালারির) নিরপেক্ষ জোন পেরিয়ে’ যান বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। জেনা সমর্থকদের ওপর অগ্নিকুণ্ডলী নিক্ষেপের জন্য নিজ সমর্থকদের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে চেমি লাইপজিগ।
ফুটবল মাঠে দুই দিনে এমন হৃদয়বিদারক দুটি ঘটনা ঘটল। ফুটবলে সমর্থকদের দাঙ্গা নতুন কিছু নয়, অতীতে এমন ঘটনায় হতাহতও হয়েছেন অনেকে। দাঙ্গা থেকে ঘটেছে বড় রকমের দুর্ঘটনাও। তাতে মারাও গেছেন অনেক। আসুন তেমন কিছু হৃদয়বিদারক ঘটনায় চোখ ফেরাই-
ইন্দোনেশিয়ার ‘ট্র্যাজেডি’
২০২২ সালের ১ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার মালাংয়ে কানজুরুহান ফুটবল স্টেডিয়ামে আরেমা এফসিকে ৩-২ গোলে হারায় পেরসেবায়া সুরাবায়া। ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ তখন জানিয়েছিল, খেলা শেষে আরেমার দর্শকেরা মাঠে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। বার্তা সংস্থা এএফপি ও জাকার্তা পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছিল।
[238672]
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছিল। দর্শকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং পদদলিত হয়ে অনেকেই মারা যান। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’ তখন জানিয়েছিল, স্টেডিয়ামের একটি দরজা দিয়ে অনেক মানুষ বের হওয়ার সময় শ্বাসরোধ হয়েও অনেকে মারা যান। গার্ডিয়ানের হিসাব অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ছিল ১২৫, আহত ৩২০। এ ঘটনাকে ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম ‘ট্র্যাজেডি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিসরের পোর্ট সৈয়দ স্টেডিয়ামে দেশটির প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে আল মাসরির বিপক্ষে ৩-১ গোলে জেতে আল আহলি। জয়ের পর আল আহলির সমর্থকেরা প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের উদ্দেশে ব্যঙ্গাত্মক ব্যানার তুলে ধরলে সংঘর্ষ বেধে যায় দুই পক্ষের মধ্যে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয়েছিলেন ৫০০-এর বেশি মানুষ।
পুলিশ স্টেডিয়ামের ফটক না খোলায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছিল বলে দাবি করা হয়। পদদলিত হয়েও মারা যান কেউ কেউ। পরে এই দাঙ্গা কয়েক দিন ধরে কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ঘটনায় হওয়ায় মামলার বিচারে ২০১৫ সালে ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন মিসরের আদালত। ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কায়রোর ৩০ জুন স্টেডিয়ামে জামালেক-ইনপিপিআইয়ের মধ্যকার ম্যাচে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২৮ সমর্থক মারা যান।
১৯৬৪ সালের মে মাসে পেরুর স্তাদিও নাসিওনালে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়গুলোর একটি ঘটেছিল। ম্যাচটি ছিল টোকিও অলিম্পিকের ফুটবল ইভেন্টের বাছাইপর্বে পেরু বনাম আর্জেন্টিনার। রেফারির সিদ্ধান্তে সেদিন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন পেরুর সমর্থকেরা। একপর্যায়ে দর্শকেরা মাঠে নেমে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন। সিট, বোতল ও অন্যান্য দ্রব্য ছুড়ে মারেন সমর্থকেরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। আতঙ্কিত হয়ে দর্শকেরা মাঠ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। ইস্পাতের তৈরি মূল ফটকটি ছিল বন্ধ। হুড়োহুড়ি আর গাদাগাদির কারণে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল ৩২০টি তাজা প্রাণ। আহত হওয়ার সংখ্যা ছিল ৫০০-এর বেশি।
ঘানার আক্রায় ওহেন জান স্টেডিয়ামে ২০০১ সালের মে মাসে মর্মান্তিক ঘটনাটি আফ্রিকার ফুটবল ইতিহাসের কালো অধ্যায়। সেদিন ঘানার সবচেয়ে সফল দুটি ক্লাব আক্রা হার্টস অব ওক এবং আসান্তে কোটাকো মুখোমুখি হয়েছিল। ২-১ গোলে হেরে যাওয়ায় হতাশ কোটাকোর দর্শকেরা মাঠে প্লাস্টিকের আসন ও বোতল ছুড়তে শুরু করেন। বিশৃঙ্খলা থামাতে কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে।
আতঙ্কিত হয়ে দর্শকেরা ছোটাছুটি করে বেরোনোর চেষ্টা করলে পদদলিত হয়ে মারা যান ১২৬ জন। সেই ঘটনায় আবদুল মোহাম্মেদ নামের এক দর্শক কাঁদানে গ্যাসের কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়ায় তাঁকে মর্গে ফেলে রাখা হয়েছিল। কেউ একজন তাঁর পা মাড়িয়ে দেওয়ার পর মোহাম্মেদ জ্ঞান ফিরে পান। অল্পের জন্য জীবন্ত কবর হওয়া থেকে বেঁচে যান তিনি।
১৯৮৫ সালের ২৯ মে ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে জুভেন্টাস-লিভারপুল ম্যাচ ঘিরে সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যান ৩৯ জন, আহত হন ৬ শতাধিক। ব্রাসেলসের হেইসেল স্টেডিয়ামে ম্যাচ শুরুর আগেই শুরু হয় সংঘর্ষ। লিভারপুলের সমর্থকদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে হেইসেল স্টেডিয়ামের একটি দেয়াল ধসে হতাহত হন প্রচুর। মৃতের তালিকায় জুভেন্টাসের সমর্থকই ছিল বেশি।
এআর