ময়মনসিংহ: ছয় দরিদ্র পরিবারের ৬ গৃহবধূ। ফেরি করে চলে তাদের জীবন। তাদের স্বামী আছে, আছে সংসার, সন্তান-সন্ততি। এরপরও সংসারে একটু বাড়তি উপার্জনের আশায় তাদেরকে ছুটতে হয় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে চলছেন তারা কারণ স্বামীর একার উপার্জনে তাদের সংসার চলে না। তাই ঘর থেকে বেড়িয়ে দূর গ্রামে ফেরি করতে হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের মৌলভী বাজারে দেখা হয় ফেরি করা ৬ নারীর সাথে। তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ১৫ বছর ধরে তারা ফেরি করছেন।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হারুয়া গ্রামে তাদের বাড়ি। প্রতিদিন মাথায় করে বড় বাঁশের ধামায় কাঁচ, মেলামাইনের তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র নিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন। এসব জিনিসপত্র বিক্রি করতে তাদের সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
প্রতিদিন সকালে সংসারের সব কাজ শেষ করে এই নারীরা একসাথে বেড়িয়ে পড়েন। বিক্রির মালামালসহ সবাই নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়ে ভাড়া করা নছিমনে চড়ে বসেন। বাড়ি থেকে প্রায় ২০-৩০ কিলোমিটার দূরের কোন গ্রামের কাছাকাছি নেমে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁক দিয়ে চলতে থাকেন।
‘লাগবনি মেলামাইনের জিনিস লাগবনি। আপা, চাচী লাগবনি। আছে থালা-বাটি দামী জিনিস।রাখলে আসেন আপা।’ এরকম হাঁকডাক করতে করতে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে তারা চলতে থাকেন।
কোন বাড়ি থেকে তাদের চিৎকার শুনে ডাক পড়লেই মাথার ভারী বোঝা নামিয়ে বেচা-বিক্রি শুরু করেন। সারদিন এভাবেই তাদের ব্যবসা চলে। কোন এক ফাঁকে সাথে থাকা দুপুরের খাবার খেয়ে নেন। আবার অনেকেই খাবার কিনে খান।
সারাদিনের বেচাকেনা শেষ করে সাঁঝের বেলা সবাই নির্ধারিত স্থানে থাকা অপেক্ষমান নছিমনে চড়ে আবার বাড়ি ফেরেন। বাড়ি গিয়ে আবার সাংসারিক কাজ কর্ম করে পরদিন একই ভাবে বেড়িয়ে পড়েন।
টমটম চালক রফিক মিয়া (৪৫) জানান, কিশোরগঞ্জ থেকে নান্দাইল পর্যন্ত যেতে ১০ নারীর কাছ থেকে প্রতিদিন তিনি ৯শ’ টাকা ভাড়া নেন। প্রতি নারীকে ভাড়া বাবদ দিতে হয় ৯০ টাকা’।
এই দলের মিনারা খাতুন (৩৫) বলেন, গ্রামে ঢোকার সময় তাদের মাথায় থাকে ৩০ থেকে ৪০ কেজি ওজনের মালপত্র। বিক্রি করার পর থেকে মালের ওজন কমতে থাকে।
ফাতেমা বেগম (৩০) জানান, তারা দল বেঁধে টঙ্গী অথবা ভৈরব বাজার গিয়ে মালামাল কিনে এনে বিক্রি করেন।
আনোয়ারা খাতুন (৪৫), মালেকা (৩২), বেদেনা আক্তার(৩৭) ও জমিলা (৩৫) জানান, ‘এ কাজে পরিশ্রম অনুযায়ী লাভ তেমন হয় না, অন্য কোন কাজ পেলে একাজ ছেড়ে দিতাম’।
শ্রমজীবি নারীরা আরও জানান, প্রতিদিন খরচ বাদ দিয়ে তাদের একেক জনের ২০০ টাকার মতো লাভ থাকে। স্বামীর আয়ের সাথে তাদের টাকা মিলে কোন রকম চলে যাচ্ছে সংসার। বইয়া থাকলে টেহ্যা (টাকা) কে দিবো? গ্রামে ফেরি করি, এটাই আমাদের ব্যবসা। তা না করলে খাব কি? উল্টো প্রশ্ন করেন তারা।
স্থানীয় মাদারীনগর গ্রামের গৃহবধূ আলপিনা বলেন, ফেরি করা মহিলাদের নিকট থেকে ঘরে বসে আমরা বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখতে পারি। এতে আমাদের জন্য খুবই ভালো।
আরেক গৃহবধূ জমিলা বলেন, হাতের কাছে জিনিসপাতি পাই, দরদাম করে কিনতে পারি। ভালোই লাগে।
নান্দাইলের ১০ নং শেরপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন ভুইয়া মিল্টন বলেন, ‘এসব মহিলাদের কাজকর্ম দেখে উৎসাহিত হই। শ্রম দিয়ে তারা অবশ্যই সম্মানের সাথে জীবিকার জন্য কাজ করছেন।’
আইএ