বরিশাল: ধারণক্ষমতার পুরো যাত্রী পাওয়ার পরও ঢাকা-বরিশাল রুটে আর ফ্লাইট চালাবে না ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ৭ সেপ্টেম্বর থেকে এই রুটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের সার্ভিস। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমানও হাঁটছে একই পথে।
পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটের অজুহাতে দৈনিক ফ্লাইটের স্থলে চলছে সপ্তাহে তিন দিন, তাও আবার অসময়ের সূচিতে। বিষয়টিকে এই রুটে সার্ভিস বন্ধের ষড়যন্ত্র বলছেন অনেকে।
এমন পরিস্থিতিতে ইউএস-বাংলার সার্ভিস বন্ধ হলে আকাশপথে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বরিশাল। জরুরি প্রয়োজনে কম সময়ে যেতে পারবে না কেউ।
পদ্মা সেতু চালুর আগে দৈনিক ২টি ফ্লাইট চালাত ইউএস-বাংলা। একটি করে ফ্লাইট ছিল বিমান ও নভোএয়ারের। উড়োজাহাজ সংকটের কারণে এই রুটে সার্ভিস বন্ধ করে নভো। পরের আঘাত আসে বিমানের কাছ থেকে। যাত্রী সংকটের অজুহাতে সপ্তাহে ৩ দিন ফ্লাইট চালাতে শুরু করে তারা। অথচ তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি যাত্রী বহনের রেকর্ড ছিল তাদের। এরপর দৈনিক ২টি ফ্লাইটের পরিবর্তে একটি চালাতে শুরু করে ইউএস-বাংলা। যাত্রী নেই বলে তারাও।
নাগরিক পরিষদের সদস্যসচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটা ঠিক যে পদ্মা সেতু চালুর প্রথমদিকে যাত্রী কমে যায় আকাশপথে। তবে তা এত কম ছিল না যে ফ্লাইট বন্ধ করতে হবে। এরপরও কেন তারা ফ্লাইটের সংখ্যা কমাল বা বন্ধ করল, সেটা তারাই বলতে পারবে।’
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বরিশাল বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সেতু চালু হওয়ার আগে দৈনিক ফ্লাইট চলত ৪টি। তখন মাসে যাতায়াত করতেন ১০-১১ হাজার যাত্রী। সেতু চালুর পর প্রথম কয়েক মাস তা নেমে আসে ৭-৮ হাজারে। পরে আবার তা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ইউএস-বাংলার দৈনিক ১টি ও বিমানের সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট মিলিয়ে মাসে প্রায় ৬ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করছেন। এই হিসাবে সেতু চালু হওয়ার আগের তুলনায় যাত্রী বেড়েছে। এরপরও কেন বিমান বন্ধের ষড়যন্ত্র আর ইউএস-বাংলা বন্ধ হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।’
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট চালানো শুরু করলেও যাত্রী পরিবহণে লাভজনক অবস্থানে ছিল বিমান। মাসে সাড়ে ৮ লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া বরিশালের সেলস অফিস সর্বশেষ জুলাইয়েও আয় করেছে ৪৫ লাখ টাকার বেশি। এমনকি সেতু চালু হওয়ার পরও গত বছর তারা ধারণক্ষমতার শতকরা ৭৫ ভাগ যাত্রী বহন করেছে।
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে বিমানের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সেতু চালু হওয়ার পরও আশানুরূপ যাত্রী নিয়েই চলছিল বিমান। হঠাৎ আসে দৈনিকের স্থলে সপ্তাহে ৩ দিন ফ্লাইট চালানোর ঘোষণা। বিষয়টি এমন যেন ঢাকায় যাওয়ার জন্য বিমানে ওঠা নয়, বিমানে ওঠার জন্য ঢাকায় যাবে যাত্রী। তারপরও বিমানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি মানুষ। এরপর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আসে আরেক দফা সময়সূচি পরিবর্তনের ঘোষণা। এবার দুপুর-বিকাল মিলিয়ে এমন সূচি দেওয়া হয়, যেটি যাত্রীদের জন্য পুরোপুরি অসময়। বরিশাল থেকে দুপুর ১২টা আর বিকাল সাড়ে ৪টার বিমানে ঢাকা যাওয়া মানে পুরো দিনটিই মাটি। কেন এই সময়সূচি নির্ধারণ, তা ঢাকার কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন।’
সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক নজমুল হোসেন আকাশ বলেন, ‘মানুষ বিমানে উঠবে তার প্রয়োজনে, বিমানের প্রয়োজনে নয়। কিন্তু বিমান যা করছে তাতে মনে হচ্ছে, যাত্রী যাতে বিমানে না ওঠে সেটাই টার্গেট। বরিশাল নগর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যাত্রী আনা-নেওয়ার সার্ভিসটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেলস অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি বিকল বছর অধিককাল। এগুলো তো যাত্রী তাড়ানোর লক্ষণ। এরপর একদিন তারাও বলবে যে যাত্রী নেই তাই সার্ভিস বন্ধ। অথচ যাত্রীদের যে তারাই তাড়াচ্ছে, সেটি দেখবে কে?’
বিমানের এই তুঘলকির মধ্যে যাত্রীদের ভরসা ছিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। যাত্রীসেবা আর নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে আস্থাও পায় তারা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ধারণক্ষমতার ৮৪ ভাগ যাত্রী বহন করে ইউএস-বাংলা। কেবল জুলাইয়েই ধারণক্ষমতার ৯২ ভাগ যাত্রী ওঠে তাদের উড়োজাহাজে। এরপরও ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিল এই এয়ারলাইন্স।
সংস্থার গণসংযোগ বিভাগের জিএম কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ধারবাহিকভাবে লোকসান দিচ্ছি আমরা। যাত্রী সংকটের কারণে এটা হচ্ছে। এজন্য আপাতত সার্ভিস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
গত এক বছরের যাত্রী পরিবহণ পরিসংখ্যান তুলে ধরে কীভাবে লোকসান হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে কয়েক মাস ধরে যাত্রী বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বছরান্তের হিসাবে লাভের দেখা মিলছে না। তাছাড়া বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে জ্বালানি তেলের দামও। সবমিলিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তাই বাধ্য হয়ে বন্ধ করা হচ্ছে ফ্লাইট।’
ইউএস-বাংলার এই বক্তব্য মানতে নারাজ বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু। তিনি বলেন, ‘চরম যাত্রী সংকটের পরও লঞ্চ চালানো বন্ধ করেননি মালিকরা। সেখানে পরিপূর্ণ যাত্রী হওয়ার পরও কেন উড়োজাহাজের সার্ভিস বন্ধ করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। জনসেবা খাতে সব সময় লাভের আশা নিয়ে ব্যবসা করা যায় না।
ঢাকা-বরিশাল দেশের অন্য যে কোনো উড়াল পথের চেয়ে লাভজনক। মাত্র ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইলের এই দূরত্বটুকু পার করতে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৮-১০ হাজার টাকা ভাড়া নেয় বিমান সংস্থাগুলো। অথচ একই ভাড়ায় এর দ্বিগুণ দূরত্বেও যাত্রী পরিবহণ করে তারা।
ঢাকা থেকে যশোর যেতে যেখানে সময় লাগে ৪০ মিনিট, সেখানে বরিশালে আসা যায় মাত্র ২০/২২ মিনিটে। অথচ এই দুই রুটে একই ভাড়া। বর্তমানে নির্বাচনের মৌসুমে কেন তারা সার্ভিস বন্ধ করল, তা তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সার্ভিস বন্ধ না করার অনুরোধ জানাচ্ছি বিমান সংস্থাগুলোকে।’
এমএস