• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

সম্ভাবনার কড়া নাড়াচ্ছে গাজীপুরের বেত শিল্প 


গাজীপুর প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪, ১০:৫৮ এএম
সম্ভাবনার কড়া নাড়াচ্ছে গাজীপুরের বেত শিল্প 

ফাইল ছবি

গাজীপুর: ৯০ দশকের আগেরকার সময়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথরিয়া সারা দেশের জনগণ গ্রাম কিংবা শহর-নগরের বাসাবাড়িতে যেসব দৃষ্টিনন্দন আসবাবপত্র ব্যবহার করত। সেই সব আসবাবপত্রের মধ্যে সব চেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে বাঁশ ও বেতের তৈরি কারুকাজময় সৌন্দর্য মন্ডিত জিনিসপত্র। তবে এ সময়কালে সৌখিন মানুষেরা বেশির ভাগই বেতের তৈরি আসবাবপত্রই তাদের বাসাবাড়িতে রাখতে পছন্দ করতেন। এ সুবাদে রাজধানীর ঢাকার পার্শ্ববর্তী হওয়ায় দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ জেলা গাজীপুরের বিভিন্ন উপজেলার মধ্যে নিদিষ্ট কিছু এলাকায় ব্যাপক ভাবে বেতের তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা ছিলো তুঙ্গে। চাহিদার বিশালতা দেখে স্থানীয় পর্যায়ে বেত শিল্পদেরও কদর ছিলো আকাশচুম্বী। 

কালের পরিবর্তনে আজ বেতের উৎপাদন,বিপণন, মার্কেটিং এবং এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট শিল্পী,কারিগর,উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায়। দিন-দিন হারাতে বসেছে এ ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য গাজীপুরের বেত শিল্প। 

জানাযায়, সারা দেশের মতো গাজীপুরে এখনো প্রচুর চাহিদা রয়েছে বেতের তৈরি কারুকাজ করা আসবাবপত্র ও পসরা সামগ্রী। বিশেষ করে পরিবেশ বান্ধব ও নিরাপদ বেতের চেয়ার, ফ্রেম করা আয়না, ইনডোর প্ল্যান্টস এর জন্য বেতের ঝুড়ি, বেতের মোড়া, প্ল্যান্ট শেলফ,বেতের ও বেতের তৈরি শিশুদের জন্য দোলনা। এছাড়া বেতের আসবাব হিসেবে বিছানা, সোফা সেট, ডাইনিং টেবিল, ওয়্যারড্রোব, ডিভানও বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। 

এছাড়া বেতের হাঁড়ি, খাঁচা, কুলা, ডুলা (শিকারির মাছ রাখার পাত্র), মাছ ধরার চাঁই (মাছ ধরার ফাঁদ), চালুনি, মাথাল, কৃষিপণ্য মাপার দাঁড়িপাল্লা, হাঁড়িসহ বিভিন্ন পণ্যেরও রয়েছে তুমুল চাহিদা। পাশাপাশি দামেও রয়েছে চমক,প্রতিটি পণ্য ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। 

দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও একটা সময়ে গাজীপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্য জাপান,জার্মানি, ইতালি, কানাডা,ফ্রান্স, চীন, ভিয়েতনাম, ইংল্যান্ড, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে পাল্লা দিয়ে রপ্তানি করা হয়েছে। আগের মতো এখন বেতন, উৎপাদন,বিপণন এবং এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট উদ্যোগক্তাদের প্রণোদনা সহযোগিতা প্রদান না করায়। দিন -দিন হারাতে বসেছে এ ঐতিহ্য শিল্পের জৌলুশ। 

দেশের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের দুর দিন শোনা গেলেও। তবে আশার কথা ও অন্য রকম এক দৃশ্য দেখা গেলো গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে বানার নদের পাড়ে সাপ্তাহিক বরমি  হাটে। এই হাটে ঢুকলেই চোখে পড়লো বেতের তৈরি নানান তৈজসপত্রের পসরা। এক একটি পসরা যেনো এক একেক ধরনের সৌন্দর্য। দেখলেই মনে চায় এখুনি এটি কিনে ফেলি। 

এ বাজারে দুর দুরান্ত থেকে আসা নানা শ্রেণি পেশার মানুষেরা জানান, প্রাচীন বটগাছের পাশে হাতে তৈরি তৈজসের এ হাটের বয়স প্রায় এক শতাব্দী। গাজীপুর ছাড়াও পাশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের হাজার-হাজার মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হাট এটি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কারিগরেরা বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে সপ্তাহে এক দিন এ বাজারে আসেন।

সাপ্তাহিক হাট বার বুধবার গেল সপ্তাহে দুপুরে বরমি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কিছু লোক বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্য বিক্রি করার জন্য এসেছেন। তাদের মধ্যে থেকে গাজীপুরের পাশের জেলা নরসিংদী থেকে আসা হরযত আলী নামের এক কারিগর বলেন, এই বরমি বাজারের ১০০ বছরের নাম ডাক আছে। এই বাজারে আগে লক্ষ টাকার বেতের তৈরি পণ্য বিক্রি করতেন। ব্যাপক চাহিদা ছিলো হাটে আসা মানুষের মধ্যে দৃষ্টিনন্দন বেত পণ্য কিনার জন্য। শুধু তাই নয় ইন্ডিয়া থেকেও অনেক লোকজন এই বাজারে বেতের তৈরি পণ্য কিনার জন্য আসতেন। তিনি বলেন, বর্তমানে এর আরও কদর বেড়েছে কিন্তু বেতের উৎপাদন কমেছে। পাশাপাশি শিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজন সরকারের কোন সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায়। এ শিল্প সামনে আগাইতে পারছেনা। 

শ্রীপুরে বেত পণ্যের সফল ব্যবসা নিয়ে কথা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য রুমানা আলী টুসির সঙ্গে। তিনি বলেন, একটা সময়ে বরমি বাজারের বেত পণ্যের পসরা সামগ্রী কিনতে দেশের বিভিন্ন জেলার লোকজন আসতো। শোনেনি এখান থেকেই পণ্য কিনে বিদেশেও নাকি পাঠানো হয়েছে। তবে এখন এ শিল্প কি কারণে ভাটা পড়েছে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। 

এ দিকে জেলার জয়দেবপুর শিববাড়ি বরকত স্মরনীতে গিয়ে জানা যায়,আলম নামে এক লোক বেতশিল্পের ছোট খাট একটি দোকান গড়েছেন। তার ভাষ্যমতে, বাজার প্রতিযোগিতায় শ্রমের মূল্যে না থাকায় বেত কারিগররা হতাশ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ফলে দিনে দিনে বেতের তৈরী সৈাখিন আসবাবপত্র অনায়াসে এ ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। 

এই ব্যবসায়ীর মতে, শুধু গাজীপুর নয় সারা দেশেই বেত শিল্পের এক অনন্য বৈশিষ্ট ও ঐতিহ্য রয়েছে। যদি এ শিল্পকে বিকশিত করা যায়। তাহলে এটি বিদেশি রপ্তানি আয়ের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া এ শিল্পের পরিধি বাড়িয়ে অনেক লোকজনের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা সম্ভব। তিনি বলেন, এ জন্য শুধু দরকার সরকারের স্বদিচ্ছা। 

গাজীপুরসহ দেশের পেশাদার শিল্প ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারী উদ্দ্যোগে রোপন করা বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটেয়ে আছে অযত্নে অবহেলায় বেত গাছের বাগান। এ গুলো যত্ন নেওয়ায় পাশাপাশি আরও বেশি করে বেত বাগান গড়ে তুলার উদ্যোগ নিতে হবে। 

তিনি বলেন, এক সময়ে দেশের বেত ১৫০ টাকা দিয়ে কিনে ভাল মুনাফা সফল পণ্য তৈরি করে কারিগর বিক্রি করে তাদের সংসারের জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে বার্মা, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানী হয়ে ১২০০ টাকায় বেত কিনতে হচ্ছে ঢাকা, চট্রগ্রাম, বনানী পাইকারী বাজারে। এরুপ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় অনেকে চলে গেছে এ ব্যবসা থেকে। এসব বেতের তৈরী জিনিসের দামও অনেক। যদি শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট শিল্পী কারিগর ও উদ্যোগক্তাদের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার প্রয়োজন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাহলে আবারও সোনালী ঐতিহ্য ফিরে পাবে দেশের বেত শিল্প। 

সোনালীনিউজ/এমএস/এসআই


 

Wordbridge School
Link copied!