রংপুর: ইমরান খান মুকুল। স্বপ্ন ছিল একদিন জাতীয় দলে খেলবেন তবে অভাবের সংসারে তা আর হয়ে ওঠেনি। জীবিকার তাগিদে চাকরি করছেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ল্যাব সহকারীর। নিজের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলে এলাকার প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়ে তুলেছেন দেউতি ক্রিকেট একাডেমি। শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে স্বপ্ন দেখছেন সফলতার।
মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) বিকেলে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার দেউতি পুরাতন মাঠে গিয়ে সরেজমিন প্রায় ২০ থেকে ২৫জন খেলোয়ারকে অনশীলন করতে দেখা গেছে। মাঝে একজনকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে দেখা যাচ্ছে তিনি এই ক্ষুদে ক্রিকেটারদের কোচ ইমরান খান মুকুল।
অনুশীলনের মাঝে কথা হয় সোনালি নিউজের প্রতিবেদকের সাথে দেউতি ক্রিকেট একাডেমি কোচ ইমরান খান মুকুল বলেন, “আমার এখানে অনেক খেলোয়ার প্রতিভাবান আছে। যাদের একটু নজর দিলে ভালো কিছু করবে তারা। আসলে গ্রামে অনেক প্রতিভা তৈরি হয় কিন্তু বিকশিত করার জায়গা থাকে না। আমি আসলে এই জায়গাটা তৈরি করতে চাই। যদি প্রতিভা থাকে আপনি জঙ্গল থেকে গিয়েও কিন্তু ভালো করতে পাবেন ইনশাআল্লাহ। আমি প্রতিভা তৈরি করতে চাই এখানে।”
ইমরান খান মুকুল জানান, “এই মাঠে চারপাশেই খোলা ক্রিকেট খেলতে গেলে সোজা ব্যাটে ব্যাট করতে হয়। সোজা ব্যাটে ব্যাট করলে বল কারো গায়ে লাগে না। আমাদের খাঁচা নেট নাই ছেলেরা আসে খেলে চতুর্পাশে মহিলারা থাকে, বাচ্চারা থাকে অনেকের গায়ে বল লাগে মহিলারা গালাগালি করে।”
এই একাডেমির কোচ ইমরানের চাওয়া সরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এগিয়ে আসলে ভালো কিছু উপহার দেওয়া সম্ভব অজোপাড়া গাঁয়ের এই মাঠ থেকে তার দাবি, “পৃথিবীতে সব মানুষ মিথ্যা কথা বলবে কিন্তু তোমাদের পরিশ্রম কখনও মিথ্যা বলবে না। আমার বিশ্বাস একাডেমির ছেলেরা যদি পরিশ্রম করে। যদি তারা পরিশ্রমীতে বিশ্বাসী হয় এখান থেকে অনেক প্রতিভা তৈরি হবে। এখান থেকে আগামীর মোস্তাফিজুর রহমান তৈরি হবে। মাশরাফি তৈরি হবে, সাকিব আল হাসান তৈরি হবে ইনশাল্লাহ। একসময় আশরাফুলও তৈরি হবে আমার এই একাডেমি থেকে।”
অনুশীলন করা অনেক খেলোয়ার অভাবের সংসারে পড়া লেখার পাশাপাশি ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা থেকেই নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদের কেউ হতে চান মুস্তাফিজ কিংবা মিরাজ আবার অনেকেই সাকিব হয়ে উজ্জ্বল করতে চায় দেশের মুখ।
মাঠে অনুশীলন করা আব্দুল্লা আল মাহমুদ আপন নামের ক্রিকেটার জানান, “আমার মাঝে যে প্রতিভা আছে আমি জাতীয় দলে চান্স পাবো। আমি এ পর্যন্ত অনেক জায়গায় খেলছি। আমি স্কুল উইন্টার স্কুল লীগ পর্যন্ত খেলছি। আমার মনে হয় জাতীয় টিমে চান্স পাবো। আমি যদি মোস্তাফিজকে দেখি সে অঝোপাড়া গাঁ থেকে আসছে মেহেদী হাসান মিরাজ অঝোপাড়া গাঁ থেকে আসছে। সেইরকম আমার চিন্তা ভাবনা আছে আমি অঝোপাড়া গাঁ থেকে উঠে যেতে পারবো।”
সজিব আহমেদ আরেক ক্রিকেটার বলেন, “আমি ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ভালো ক্রিকেটার হবো। আমার আশা যে বাংলাদেশ টিমে খেলবো। আমি চাই আমার দেশকে এই ক্রিকেটের মাধ্যমেই ইনশাআল্লাহ এগিয়ে নিয়ে যাবো। এখান থেকে আমি চাই বাংলাদেশ টিমে খেলবো খেলে পুরো বাংলাদেশকে জাতীর বুকে টেনে ধরবো। আমরা চাই যে আমাদের বড় ভাই বা অনেকে আছেন হেল্প করুন আমাদের একাডেমিটাকে ধরে রাখতে পারি যেন। আমাদের একটু সাহায্য করলে ভালো কিছু করবো ইনশাআল্লাহ। ”
২০১০ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল দেউতি ক্রিকেট একাডেমির। আর্থিক টানাপোড়েনে ধুকে ধুকে চলে কার্যক্রম। চার বছরের মাথায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় একাডেমিটি। নতুন উদ্যোমে বড় স্বপ্ন নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করা একাডেমিতে এখন খেলোয়াড় প্রায় ৫০জন। আগামী দিনের ক্রিকেটকে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা চায় তারা।
শিহাবুল ইসলাম পাভেল নামে এক ক্রিকেটার জানান, “মূলত মোস্তাফিজকে দেখে ক্রিকেট শিখছি। আমিও বাম হাত দিয়ে বল করি সেই জন্য আমি ক্রিকেটে প্রাকটিস করতেছি। আমার বাবারও স্বপ্ন আছে আমাকে ক্রিকেটার বানাবে। আমাদের সমস্যা আছে অনেক কিন্তু এখন প্রয়োজন হলো জার্সি, বলের সংকট, ভালো কোন নেট নাই।”
রাকিব হাসান নামে আরেক ক্রিকেটার বলেন, “আমাদের অনেককিছুর প্রয়োজন হয় প্রাকটিস করতে সেগুলো আমরা সময়মতো পাই না। আমাদের যদি একটা খাঁচার নেট হয় প্রাকটিস করতে সুবিধা হয়। তার পরে ধরেন এই জায়গাটা যদি একটু ভালো হইতো তাহলে বোলারদের বল করতে ভালো হইতো।”
পশ্চিম দেউতি সুন্দরপাড়া গ্রামের মশিউর রহমান নামে এক অভিভাবকের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের তিনি জানান, “আমার ছেলেকে আমি বড় ক্রিকেটার বানাতে চাই। ছেলেও স্বপ্ন সে একজন ভালো ক্রিকেটার হবে। কিন্তু আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটু চাপের। তবে যতটুকু পারি ছেলেকে প্রেরণা দেবার চেষ্টা করি। ছেলেটাই বলে যে মোস্তাফিজ নাকি অজপাড়া গাঁ থেকে এসেছে। আমিই শুনি রোক মুখে শুনি ছেলেটা নাকি অনেক ভালো খেলে। মানুষের মুখে সন্তানের প্রশংসা শুতে বেশ ভালোই লাগে।”
তৃণমুলের এমন প্রতিভাবান খেলোয়ারদের এগিয়ে নিতে বিসিবির তত্ত্বাবধানে খেলোয়ারদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার উঠে আসবে বলে মনে করেন রংপুর ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক ক্রিকেটার শাকিল রায়হান।
কথা হয় তার সাথে তিনি বলেন,“তৃণমুল পর্যায়ে চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলররা যদি খেলোয়ারদের সমস্যাগুলো উপরে জানান তাহলে সহযোগীতা পাওয়া সুবিধা হবে। বিসিবি বা ক্রিড়া মন্ত্রণালয় থেকে সুযোগ সুবিধা সবকিছু আছে নাই বললে ভুল হবে। প্রতিটা জেলায় যদি একটা ইন্ডোরের ব্যবস্থা করা যেত, ক্রিকেট বোর্ড যদি বিকেএসপির মত প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারতো প্রতিটা জেলায় একটা করে। আমার মনে হয় যে খালি একটা প্লেয়ারে তৈরি হতো না একটা সুন্দর সমাজ গঠন হতো।”
তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা এধরণের একাডেমিগুলো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের ক্রিকেট অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা বলে মনে করছেন ক্রীড়া বিশ্লেষকরা।
এমএস