সাতক্ষীরা: তীব্র গরম পড়ার আগেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের তাপদাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
উপকূলীয় এ অঞ্চলের চারপাশে পানি থইথই করলেও তীব্র সংকট নিরাপদ খাবার পানির।
সাতক্ষীরা উপকূলের শ্যামনগরে খাবার পানি সংগ্রহে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয় মানুষকে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অপরিকল্পিতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং লবণাক্ততার সমস্যা দূর করতে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত উদ্যোগ তদারকির অভাবে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় পরিবেশ কর্মীদের।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর শ্যামনগর উপজেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এ এলাকার ৪০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এ তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ বলে দাবি স্থানীয়দের।
শ্যামনগর উপকূলের মানুষ খাওয়ার পানি ও দৈনন্দিন কাজের জন্য মূলত পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল।
তবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘেরের আউটড্রেন না থাকা, নদীর প্রবাহ আটকে দেওয়া, পুকুর ভরাট ও খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক মানুষ নিরাপদ পানির তীব্র সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন।
সাধারণত শীত মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা সময় এ দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় উপকূলবাসীকে।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপেজেলায় এক হাজার ৯৪৯টি গভীর, ৪৯১টি অগভীর, ৫০০টি এসএসটি ও ৪৪১টি ভিএসএসটি নলকূপ রয়েছে।
এর মধ্যে আটটি গভীর, ১২৯টি অগভীর, ১৬টি এসএসটি ও ৪৪টি ভিএসএসটি নলকূপ কয়েক বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
উপজেলার কৈখালী এলাকার বাসিন্দা মোশারফ গাজী বলেন, এক কলস পানির জন্য দুই-তিন ঘণ্টা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তিন-চার কিলোমিটার পথ হেঁটে অর্ধবেলা ব্যয় করে সংগ্রহ করতে হয় এক কলস খাওয়ার পানি।
উপজেলার জয়াখালী মোড়ে আকিজ কোম্পানির তৈরি পানির ফিল্টার থেকে পানি নিতে আসা কৈখালী এস আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া পারভীন বলে, আমাদের বাড়ি সাপখালি। যা এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে সকাল ৭টার দিকে পানি নিতে এসেছি আমি আর এলাকার চাচিরা। আমার স্কুল ১০টা থেকে। এখন বাজে ৯টা। এখান থেকে যেয়ে স্কুল ধরতে পারব কিনা জানি না।
স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে কেন পানি নিতে এসেছো এমন প্রশ্নের উত্তরে সুমাইয়া বলে, আমরা গরিব মানুষ। বাবা জোন (দিনমজুর) দিতে গেছে। বাবা কাজ না করলে খাব কী? মা বাড়িতে কাজ করছে। এজন্য আমি এসেছি পানি নিতে। প্রতিদিনই পানির জন্য এ পথ পাড়ি দিতে হয়। কষ্ট হলেও করতে হয়।
এ অবস্থা শুধু কৈখালি ইউনিয়নে নয়, পার্শ্ববর্তী রমজাননগর, ঈশ্বরীপুর, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুরসহ গোটা উপকূলে একই অবস্থা বলে জানান স্থানীয়রা।
রমজাননগর এলাকার শেখ বাড়ির পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করতে বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে এসেছেন আমেনা বেগম। তিনি বলেন, সামনের বর্ষা পর্যন্ত এভাবেই পানি টেনে আমাগো খাইতে হইবো।
উপজেলার দেওল এলাকার তিন রাস্তার মোড়ে একটি ট্যাপ বসানো হয়েছে। ট্যাপটিতে পানি আসে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের কালীগঞ্জ উপজেলার সোতা গ্রামের ইমান আলীর বাড়ি থেকে। সেখানে বন্ধু এনজিও সৌরবিদ্যুৎচালিত গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে আশপাশের গ্রামে সরবরাহ করে। সূর্য ওঠার পর সোলার প্যানেলের শক্তি সঞ্চয় শেষে ইমান আলীর বাড়িতে বসানো ট্যাংক ভর্তি করে পানি ছাড়া হয় সকাল ১০টার পর। সেই পানি দেওল গ্রামে পৌঁছাতে সকাল ১১টা বেজে যায়। দুই-তিন কিলোমিটার দূরবর্তী পাটনীপুকুর, কাঠালবাড়িয়া, খুটিকাটা, নকিপুর ও শংকরকাঠি এলাকা থেকেও কয়েকশ নারী ও শিশু সেখানে আসেন খাবার পানি সংগ্রহ করতে।
পানি নিতে আসা নারী ও শিশুরা জানান, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সময় অপচয়ের পাশাপাশি তাদের প্রচণ্ড কষ্ট হয়। তবে খাওয়ার উপযোগী পানি নিয়ে এমন কষ্ট কেবলমাত্র দেওল আর তৎসংলগ্ন পাটনীপুকুর, শংকরকাঠি, কাঠালবাড়িয়া এলাকায় নয়, শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর, কৈখালী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কাঁচড়াহাটিসহ উপজেলার প্রায় সর্বত্র একই পরিস্থিতি। তাপমাত্রা বাড়লে খাওয়ার পানির সংকট আরও বাড়বে বলে জানান তারা।
উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের বড়কুপটের বৈদ্য বাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সুনীল কৃষ্ণ বৈদ্যের বাড়িতে একটি এনজিওর বসানো পানির প্লান্ট থেকে পানি নিচ্ছেন কয়েকজন।
পানি নিতে আসা পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঝাপা গ্রামের অনিল কৃষ্ণ মণ্ডল জানান, আমি নদী পার হয়ে নৌকা নিয়ে এসেছি পানিতে। আমাদের এলাকায় খাবার পানি উৎস নেই। অন্যান্যরা পুকুরের লবণ পানি খেয়ে কোন রকমে চলেন। আমি আমার পরিবারের জন্য ১০টি ৩০ লিটারের ড্রাম নিয়ে পানি নিতে এসেছি। ১৫০ টাকা দাম নেয় এ পানির। এ ১৫০ টাকার পানিতে চার থেকে পাঁচ দিন চলবে। এভাবেই আয়ের অধিকাংশ টাকা চলে যায় পানি কিনতে।
পানির প্লান্টের দেখভালকারী সুনীল কৃষ্ণ বৈদ্য জানান, এখান থেকে পদ্মপুকুর, ঝাপা, দুর্গাবাটি, আড়পাঙ্গাসিয়া, হেন্সি, বুড়িগোয়ালিনীসহ পার্শ্ববর্তী অনেক এলাকার মানুষ পানি নিয়ে যান। প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার লিটার পানি বিক্রি হয়। গরম পড়লে আরও বাড়বে।
শ্যামনগর পৌরসভার বাদঘাটা এলাকায় মৌসুমী ড্রিংকিং ওয়াটার প্লান্ট নামে পানির ব্যবসা খুলেছেন মো. শাহিনুর রহমান (মশিউর)। এতে ছয় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ঘণ্টায় এক হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করা যায় তার প্লান্টে। প্রতি লিটার পানি বিক্রি করেন দুই টাকায়। শুধু মশিউর নন, এমন ওয়াটার প্লান্ট বসিয়ে পানির ব্যবসা খুলেছেন পৌরসভা এলাকার আরও অনেকে। সেখান থেকে পানি কিনে পান করেন এখানকার মানুষ।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী হাফিজুর রহমান হাফিজ বলেন, গ্রীষ্মের তাপদাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করবে। সরকারের পক্ষ থেকে পানির ব্যবস্থা না করলে এখানকার মানুষ তীব্র্র পানি সংকটে পড়বে। এতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
তিনি এর একটি স্থায়ী সমাধান এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সরকার ও সকল উন্নয়ন সংস্থাকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
শ্যামনগরের জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। শুধুমাত্র দুর্যোগের সময় সরকারিভাবে দুর্গতদের মধ্যে খাওয়ার পানি বিতরণ করা হয়। রপানির সমস্যা দূর করতে শ্যামনগরে জনস্বাস্থ্য বিভাগের পিএসএফ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, গভীর ও অগভীর নলকূপ, রিভার্স অসমোসিস, পুকুর, দীঘি ও ম্যানেজ একুইফার রিসার্চ মিলিয়ে প্রায় আট হাজার পানির উৎস রয়েছে। তবে বৃষ্টির অভাব, বন্যায় এলাকায় লবণ পানি ঢুকে যাওয়ায় ও পুকুর, জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় পিএসএফ ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, কিছু এনজিও পানি সরবরাহের কাজ করলেও জনস্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় না করায় তাদের পানি সরবরাহের বিষয়ে কোনো তথ্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে নেই।
এমএস