• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতেই স্ত্রীসহ দুই সন্তানকে খুন


সোহাগ রহমান, ময়মনসিংহ  মে ২৩, ২০২৪, ০৯:৪৩ পিএম
মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতেই স্ত্রীসহ দুই সন্তানকে খুন

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কাকচর গ্রামের নয়াপাড়ায় নারী ও দুই শিশুর হত্যাকাণ্ডের আসামি আলী হোসেন (৩৫) কে গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। 

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের সভাকক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শামীম হোসেন সাংবাদিকদেরকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, গ্রেফতারকৃত আসামি নুর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদেরকে সে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। আসামি আলী হোসেন দিন মজুরের কাজ করত। তার কোনো জমিজমা ছিল না। অভাবের সংসারে স্ত্রী আমেনা খাতুন এবং দুই ছেলে ছিল তার। বড় ছেলের নাম আবু বক্কর সিদ্দিক (৪) ও ছোট ছেলে আনাছ (২ বছর ৬ মাস)। তিনি তার চাচার দেওয়া জমিতে অনেক দিন ধরে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। সংসারে সারা বছর অভাব অনটন লেগেই থাকত। ঠিকমত তার সংসার চালাতে পারতো না। তাই সে বিভিন্ন সময় তার স্ত্রী ভিকটিম আমেনার নাম দিয়ে এনজিও থেকে টাকা তোলতো। বেশ কিছুদিন পূর্বে সে এনজিও থেকে ১ এক লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। সেই টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় তাকে এবং তার স্ত্রীকে অপমান করা হতো। প্রায়ই তার ছেলে ও বউ না খেয়ে দিন কাটাতো।

ঋণের বোঝা, মানুষের অপমান ও সংসারের অভাব অনটন থেকে মুক্তি পেতে ২ থেকে ৩ মাস পূর্বে আলী হোসেন সিদ্ধান্ত নেয় তার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করবে। পূর্ব পরিকল্পনা মতে আসামী আলী হোসেন গত ১৭ মে (শুক্রবার) রাত অনুমান ২টায় তার স্ত্রী ও দুই সন্তান ঘরে ঘুমিয়ে থাকাবস্থায় তার স্ত্রী আমেনা খাতুনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। তার স্ত্রী আমেনা খাতুন বিছানা থেকে নেমে ঘরের মেঝেতে গিয়ে বসলে আলী হোসেন তার পিঠের পিঁছনে গিয়ে তার গায়ে থাকা ওড়না দিয়ে আমেনা খাতুনের গলায় পেঁচিয়ে মাটিতে ফেলে দুই হাত দিয়ে টান দিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। 

এরপর বিছানায় আসামী আলী হোসেনের দুই ছেলে ঘুমিয়ে থাকাবস্থায় তার স্ত্রীর গলা থেকে ওড়না খুলে নিয়ে প্রথমে ছোট ছেলে আনাছের গলায় ওড়না পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং পরপরই তার বড় ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিকের গলায় ওড়নার বাকী অংশ দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

পরে আসামী আলী হোসেনের স্ত্রীকে কাঁধে তুলে নিয়ে ঘরের পেছন দিয়ে জঙ্গলে নিয়ে রাখে এবং এর পরপরই তার দুই ছেলেকেও কোলে করে ওই জঙ্গলে নিয়ে আসে। তারপর জনৈক ইউসুফ ও কালামের জমির মাঝখানে সীমানা বরাবর মাটিতে গর্ত করে তার স্ত্রী ও তার দুই সন্তানকে পুতে রাখে। ভোরের দিকে সেখান থেকে চলে এসে আসামী ঘরে ঘুমিয়ে পরে।

আসামী আলী হোসেন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সকাল অনুমান ১০টায় বাড়ী হতে হরিরামপুর এলাকায় চলে যায় এবং বিকেলে বাড়ীতে ফিরে এসে মালামাল নিয়ে গফরগাঁও উপজেলার মশাখালী স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে কমলাপুর রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করে। ডিবির হাতে গ্রেফতারের আগে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় গোপনে ছিল আলী হোসেন।

প্রকাশ, গত ২১ মে দুপুরে ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কাকচর গ্রামের নয়াপাড়ার প্রবাসী জনৈক কামরুল হাসানের চাষের জমির আইলের পাশে মাংস বিহীন হাড় মাটির ওপর পড়ে থাকা সংক্রান্ত সংবাদের ভিত্তিতে ওসির নেতৃত্বে ত্রিশাল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে মোট ৩টি অর্ধগলিত, পোকায় খাওয়া লাশের মধ্যে ২টি শিশুর লাশ ধান ক্ষেতের ওপর এবং ১টি লাশ আইলের পাশে মাটিতে পুতে রাখা অবস্থায় দেখতে পায়। মাটিতে পুতে রাখা লাশ উত্তোলন করে একটি মহিলার অর্ধগলিত লাশ সনাক্ত হলেও পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি। থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশে অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই, সিআইডি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রযুক্তির সহায়তায় লাশের পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা করেন কিন্তু লাশগুলো অর্ধগলিত হওয়ায় এবং শিশু বাচ্চা দুইটির লাশ মস্তক বিহীন হওয়ায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলেই লাশগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতসহ আনুষাঙ্গিক অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করে ময়না তদন্ত ও ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রেরনের জন্য লাশগুলো ত্রিশাল থানায় নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজন থানায় এসে ভিকটিমদের পড়নের কাপড়-চোপড় এবং অন্যন্যা বৈশিষ্ট দেখে পরিচয় সনাক্ত করেন। সনাক্তকৃত পরিচয় থেকে জানা যায়, তিনটি লাশ আলী হোসেনের স্ত্রী আমেনা খাতুন (২৫), ও দুই শিশু ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিক (৪) ও আনাছ (আড়াই) এর। সনাক্তকৃত লাশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক হল মা এবং সন্তান।

ভিকটিমের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ভিকটিমের পরিবার আমেনা খাতুন কিংবা তার স্বামী আলী হোসেনের সাথে গত বৃহস্পতিবারের পর থেকে মোবাইলে যোগাযোগ করতে না পেরে আলী হোসেনের নিজ বাড়ীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আলী হোসেন ঢাকার উদ্দেশ্যে স্ত্রী ও  দুই সন্তান নিয়ে গত শুক্রবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। তারপর থেকে আলী হোসেন পলাতক।  

গত ২২ মে ভিকটিম আমেনা খাতুনের মা মোছাঃ হাসিনা খাতুন তার মেয়ের জামাই আলী হোসনে (৩৫) ও অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে ত্রিশাল থানায় মামলা (নং-২৩) রুজু করা হয়। মামলা দায়ের পর ময়মনসিংহ ডিবি পুলিশের একটি চৌকশ দল ওই ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও আসামী গ্রেফতারের জন্য মাঠে নামেন। তথ্য প্রযুক্তি ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে ওই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ভিকটিমের স্বামী আলী হোসেনকে গত ২২ মে গাজীপুরের শ্রীপুর থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে।

উল্লেখ্য আলী হোসেনের বিরুদ্ধে ত্রিশাল থানায় ২০১২ সালে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় একটি মামলায় ৫ বছর কারাভোগ করে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে জামিনে মুক্তি লাভ করে। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।

এমএস

Wordbridge School
Link copied!