ঢাকা: সর্বোচ্চ গতি নিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের উপকূলে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। সাগরে অবস্থান করা গভীর নিম্নচাপটি গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে রূপ নিয়েছে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। এটি আজ রাতে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া দিয়ে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। এর প্রভাবে উপকূলের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে। সাগর রয়েছে উত্তাল।
ইতিমধ্যে মোংলা ও পায়রা বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে ৯ নম্বর বিপদসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, যেসব এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করবে, সেখানে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এজন্য উপকূলীয় জেলাগুলোতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে উপকূলবাসীর।
বরগুনা সদর উপজেলার ৬ নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের এক বাসিন্দা বলেন, পানির চাপে ২০০৭ সালের সিডরে বেড়িবাঁধ ভেঙে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছিল। এবারও নাকি বড় ঘূর্ণিঝড় হবে শুনছি। তাই মনে আতঙ্ক কাটছে না।
গত তিন দিন ধরে সাগরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকা ঘূর্ণিবায়ুর চক্রটি শনিবার সন্ধ্যায় গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। তখন এর নাম দেওয়া হয় রেমাল।
পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সর্তক সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়। আর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, আরও শক্তিশালী হয়ে রেমাল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিতে পারে এবং রোববার রাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
সাগরে ঝড়ের আভাস থাকায় শনিবার দুপুরেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সভা বসে। উপকূলীয় ছয় জেলায় বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ আসে সেখান থেকে। বিকালের দিকে উপকূলীয় জেলাগুলোতে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এদিকে সারাদেশে লঞ্চসহ নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কক্সবাজারগামী রোববারের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আজ ও আগামীকাল কলকাতাগামী সব ফ্লাইটও বাতিল করেছে বিমান বাংলাদেশ। রেড অ্যালার্ট-১ জারি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার সব নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট থ্রি জারি করেছে। পাশাপাশি জাহাজ ও জেটিতে পণ্য ওঠানামাসহ বন্দরের সব কার্যক্রম শনিবার রাত ১০টা থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠেয় রোববারের সম্মান চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা।
ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, প্রবল শক্তি নিয়ে ‘রেমাল’ উপকূলে ছোবল হানতে পারে। এরপর সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলার দিকে ফণা তুলতে পারে। ক্ষত তৈরি করতে পারে সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো এলাকায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের শঙ্কাও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সরকারের তরফ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
উপকূলের ছয় জেলাকে বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সেখানে খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর এরই মধ্যে মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ পাঠানো শুরু করেছে।
আগাম সতর্কবার্তা প্রচারসহ আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন ও প্রস্তুতের কাজ করছেন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৭৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন (এএফডি), ফায়ার সার্ভিস ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে। প্রতিটি উপজেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সওজ, এলজিইডিসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থাকে সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ভারতেও নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ভারতের নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে দেশটির আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি)।
উপকূলজুড়ে প্রস্তুতি, সতর্কতা
আবহাওয়া অফিস বন্দরগুলোতে বিপদসংকেত দেখাতে বলায় স্বেচ্ছাসেবীরা লাল পতাকা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। হ্যান্ড মাইকে নিচু এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলছেন তারা। ভারী বর্ষণে ভূমিধসের শঙ্কা থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সভা করে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুলনা জেলা প্রশাসন। ঝড় মোকাবিলায় কাজ করবে কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার, তিনটি মুজিব কিল্লা ও ৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, এসব সাইক্লোন শেল্টারে ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন আশ্রয় নিতে পারবেন। এ ছাড়া তিনটি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন আশ্রয় ও ৫৬০টি গবাদি পশু রাখা যাবে।
গতকাল দুপুর ২টা থেকে চট্টগ্রামে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে নিজস্ব অ্যালার্ট-১ জারি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, প্রাথমিকভাবে বন্দর জেটি এবং বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ৫৪১ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার কথা জানিয়েছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করাসহ নদীতীরে সতর্কবার্তা প্রচার শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, চাল ছাড়াও পর্যাপ্ত শুকনো খাবার মজুত রাখা হয়েছে। জেলায় নগদ বরাদ্দ হয়েছে ৫ লাখ টাকা, যা উপজেলা পর্যায়ে বণ্টন করা হয়েছে। এতে জরুরি প্রয়োজনে যে কোনো সামগ্রী কেনা যাবে। তাৎক্ষণিক মন্ত্রণালয় থেকে আরও বরাদ্দ আনা যাবে।
বরগুনায় ৬৭৩ আশ্রয়কেন্দ্র ও তিনটি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে ৩ লাখ ২১ হাজার ২৪৪ জন আশ্রয় নিতে পারবেন। পটুয়াখালীতে জরুরি প্রস্তুতি সভা হয়েছে। সম্ভাব্য এ ঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৭০৩টি সাইক্লোন শেল্টার। ভোলায় উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে প্রচার চালাচ্ছে কোস্টগার্ড।
বাগেরহাটে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, দুর্যোগের সময় নদীতীরবর্তী এলাকার মানুষ যাতে নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারেন, সেজন্য জেলায় ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রিমাল মোকাবিলায় নোয়াখালীর পাঁচ উপকূলীয় উপজেলায় ৪৬৬ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলে দুর্যোগকবলিত মানুষকে সহযোগিতার জন্য রেড ক্রিসেন্ট ও সিপিপির ৮ হাজার ৯১০ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এমএস