লক্ষ্মীপুর: পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ড থেকে গড়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ টন বর্জ্য সংগ্রহ পৌর কর্তৃপক্ষ। সংগ্রহকৃত বর্জ্যগুলো প্রথমে ফেলা হয় সড়কের পাশে বা জনবহুল এলাকায়। এরপর বর্জ্য সেখান থেকে নেওয়া হয় স্যানেটারী ল্যান্ডফিল এলাকায়। কিন্তু সে ল্যান্ডফিলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। এতে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ৩ বছর আগে স্যানেটারী ল্যান্ডফিল নির্মাণ করা হলেও তা এখনও কোন কাজে আসেনি।
পৌরবাসীর জন্য এ পঁচা বর্জ্য এখন যেন 'গলার কাঁটা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্জ্যের স্তুপ দিন দিন বড় হচ্ছে, আর সে বর্জ্য আগুনে পুড়িয়ে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। আবার বর্জ্য দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে পুকুর বা নিচু জমিও। ল্যান্ডফিলের পাশে বর্জ্যের স্তুপের কারণে ভয়াভহভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বর্জ্যগুলো আগুনে পোড়ানোর কারণে সৃষ্ট ধোঁয়া চড়িয়ে পড়ছে বায়ুমন্ডলে।
ল্যান্ডফিল সংলগ্ন বাসিন্দাদের অভিযোগ, বর্জ্যের দুর্গন্ধে বসবাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, ১৯৭৬ সালে ২৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত হয় লক্ষ্মীপুর পৌরসভা। বর্তমানে এটি ১ম শ্রেণীর পৌরসভা। জেলা শহরের এ পৌরসভার প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫ হাজার মানুষের বসবাস। কিন্ত পৌরসভা গঠনের ৪৮ বছর পরেও এখানে ১টি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে পৌরসভা ও জেলা শহরটির ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র ফেল হয়। ২০২১ সালে পৌর এলাকার লক্ষ্মীপুর-মজুচৌধুরীর হাট সড়কের পাশে যুব উন্নয়ন ভবনের পেছনে ১টি স্যানিটারী ল্যান্ডফিল স্থাপন করা হয়। ৩য় নগর পরিচালনা ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ (সেক্টর) প্রকল্প স্যানেটারী ল্যান্ডফিলটি বাস্তবায়ন করে এলজিইডি, ডিপিএইচই ও লক্ষ্মীপুর পৌরসভা। প্রায় ৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটির যৌথ অর্থায়ন করে বাংলাদেশ সরকার, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও ওপিইসি ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশলান ডেভেলপমেন্ট। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সংগ্রহকৃত বর্জ্য থেকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য পৃথকীকরণ করে কাজে লাগানের কথা ছিল। পচনশীল বর্জ্য দিয়ে জৈব সার ও অপচনশীল (পলিথিন-প্লাষ্টিক) বর্জ্য দিয়ে তেল উৎপাদন করা করার কথা। এছাড়া সংগ্রহকৃত মানববর্জ্যও প্রক্রিয়াজাত করে সার তৈরীর জন্য ল্যান্ডফিল পাম্প হাউজ তৈরি করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা দেয় দাতা সংস্থা। কিন্তু সরকার ও দাতা সংস্থার দেওয়া নির্দেশিত শর্ত পালন করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। নির্মাণ সহায়তাকারী কর্তৃপক্ষের শর্ত ছিল কারিগরি ও আর্থিকভাবে সহায়তা পেতে ল্যান্ডফিল স্টেশন নির্মাণের আগে ওই এলাকায় যে সব বর্জ্য ফেলা হয়েছিল, পৌর কর্তৃপক্ষ তা স্বল্প সময়ের মধ্যে অপসারণ করবে। কিন্তু সে শর্ত পূরণ করতে পারেনি পৌরসভা। পৌর এলাকা থেকে সংগ্রহকৃত বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা ও আগুনে পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণের কারণে প্রকল্প 'থমকে' গেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সুযোগ-সুবিধা থাকলেও জনবল ও অর্থের দোহাই দিয়ে তা বন্ধ রেখেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। ফলে গত ৩বছর ধরে অচল পড়ে আছে ল্যান্ডফিলটি।
পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্প থেকে জনবল ও অর্থ না দেওয়ার কারণে ল্যান্ডফিলটি চালু করা যাচ্ছে না।
তবে পৌরবাসীর অভিযোগ, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করায় যত্রতত্র আর্বজনা ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে পৌরসভা।
জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী এলাকায় ১টি ভবনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে লক্ষ্মীপুর পৌরসভা কার্যালয় অবস্থিত। কিন্ত পৌর কার্যালয়ের সামনেই সড়কের পাশে সিএনজি স্টেশনের পাশেই বর্জ্য ফেলা হয়। জনবহুল এ এলাকায় বর্জ্য রাখার কারণে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এছাড়া লক্ষ্মীপুর-রায়পুর মহাসড়কের পাশে ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন এলাকায় ময়লা-আবর্জনা ফেলছে পৌর কর্তৃপক্ষ। আর ল্যান্ডফিলের পাশে ফেলা বর্জ্যের স্তুপ দিনের পর দিন বড়ই হচ্ছে। সব ধরণের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সেখানে।
ল্যান্ডফিলের পাশে থাকা একজন জমির মালিক মো. ইমতিয়াজ। সেখানে তার ৭৭ শতাংশ জমি রয়েছে। কৃষি আবাদ হতো ওই জমিতে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক তার কৃষি জমিতে বর্জ্য ফেলা শুরু করে। তিনি বাঁধা দেওয়ায় হুমকির মধ্যে পড়েন। উপয়া না দেখে আদালতে ১৪৪ ধারার মামলা করলেও সেটা উপেক্ষা করে তার পুরো জমিতে বর্জ্যের স্তুপ দেওয়া হয়েছে।
বর্জ্যের কারণে ল্যান্ডফিল সংলগ্ন বাসিন্দাদের বসবাস হুমকির মুখে। স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কথা জানিয়ে কৃষক মো. আলম বলেন, ল্যান্ডফিলের মুখে আমাদের বসতি। ২টি ঘরে আমরা ১১জন লোক বাস করি। শিশুরাও রয়েছে। বর্জ্যের দুর্গন্ধ স্বইতে পারি না। আবর্জনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, সে ধোঁয়ায় শিশুদের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর-রায়পুর মহাসড়কের ইটের পুল এলাকার দক্ষিণ দারগাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে থাকা পুকুুর বর্জ্য দিয়ে ভরাট করা হয়। বর্জ্য না ফেলতে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে। শিক্ষার্থীদের বাঁধা উপেক্ষা করে পরিবেশ দূষণ করে সেখানে বর্জ্য ফেলা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সাইফুল ইসলাম শরীফ বলেন, আবর্জনার দুর্গন্ধে শ্বাসনালিতে ইনফেকশন হয়ে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কনজারভেশন ইন্সপেক্টর পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফয়েজ আহম্মদ জানান, দীর্ঘ সময় ময়লা ফেলার সুনির্দিষ্ট কোন জায়গা ছিল না। ময়লা দিয়ে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি খালি জায়গা পূরণ করা হতো। ২০২১ সালে পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডে সরকারি ও দাতা সংস্থার অর্থায়নে ৪ একর জমির ওপর ল্যান্ডফিল তৈরি করা হয়। এখানে মানব বর্জ্য ও গৃহস্থলির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পৃথক ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। তবে ডাম্পিং স্টেশনটিতে অপচনশীল বর্জ্য 'রিসাইকেল' ইউনিট নেই।
তিনি আরও জানান, অপচনশীল বর্জ্য বাছাইয়ের জন্য দৈনিক ভিত্তিতে ডাম্পিং এলাকায় ১৬জন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। আর্থিক সুবিধা বন্ধ হওয়ায় পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য বাছাইয়ের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা এখন আর কাজ করছে না। পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে ৩০ টন বর্জ্য সংগ্রহ হয়। যার ৪০ ভাগই অপচনশীল বর্জ্য। প্রতিদিন ৫টি ট্রাক ছোট ট্রাক, ৩৫টি ভ্যানগাড়ির মাধ্যমে ৮২ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসব বর্জ্য সংগ্রহ করেন।
শহরের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পৌরসভা বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে মাসিক ১শ' টাকার বিনিময়ে বর্জ্য নিয়ে শহরের এখানে সেখানে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া বলেন, জনবল সংকট ও অর্থ সংকটের কারণে ল্যান্ডফিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বন্ধ রয়েছে। প্রকল্প থেকে আর্থিক সহায়তা করা হলে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অন্য আরেকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে বর্জ্য থেকে জৈব সার ও জ্বালানি তেল উৎপাদন করা যায়। চলতি বছরেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি।
জেইউবি/এসআই