মাদারীপুর: কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফার্নিচার কর্মচারী শেখ হৃদয় আহমেদ শিহাব (১৮)। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহত শিহাবের মা নাছিমা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে দুপুরে খাইয়া কারখানায় যাইতেছিল। ওয় তো আন্দোলন করে নাই। ওরে কেন গুলি কইরা মারলো? আমার একমাত্র ছেলে! আমি এখন কি নিয়া বাঁচমু।আমার বাবার কাছে আমারে নিয়া যাও।’
শুক্রবার (১৯ জুলাই) দুপুরে ঢাকার বাড্ডায় কোটা বিরোধী আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শিহাব। শিহাব মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়নের রাজারচর আজগর হাওলাদারকান্দি গ্রামের শাহ আলম হাওলাদারের ছেলে।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) নিহত শিহাবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সন্তান হারিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মা নাছিমা বেগম। শোকে বাকরুদ্ধ বাবা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকছেন ঘরের এক কোনে। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে আর্তনাদ করছেন বোন। শোকে আচ্ছন্ন স্বজন-প্রতিবেশী। বাড়ির পাশের কবরস্থানে এসে ভিড় করছেন স্বজনেরা। একমাত্র নাতিকে হারিয়ে প্রলাপ বকছেন দাদা রফিক হাওলাদার।
জানা যায়, প্রায় ৮ বছর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কাঁধে আঘাত পান শিহাবের বাবা শাহ আলম হাওলাদার। এরপর থেকে ভারি কোনো কাজ করতে পারতেন না তিনি। এরমধ্যে আবার হার্টে সমস্যা দেখা দেয় তার। এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে নাছিমা বেগমের সংসারে তৈরি হয় আর্থিক সংকট। সংসারের হাল ধরতে সেলাইয়ের কাজ করতে বাধ্য হন স্ত্রী নাছিমা বেগম। কোনো মতে চলতে থাকে সংসার। তখন একমাত্র ছেলে হৃদয় আহমেদ শিহাব অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। সংসারের হাল ধরতে তাকে ঢাকায় একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজে পাঠিয়ে দেন দরিদ্র এই দম্পতি। ফার্নিচারের দোকানে প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করতো শিহাব। বেতন যা পেতো নিজের খরচ রেখে বাড়িতে বাকি টাকা পাঠিয়ে দিতেন শিহাব। শিহাবের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তার মা ও বাবা। বাকরুদ্ধ বাবার নিরবতা ও মায়ের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ। শুক্রবার রাতে গ্রামের বাড়ি শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসীর চর ইউনিয়নের রাজারচর আজগর হাওলাদারকান্দি গ্রামে মরদেহ এসে পৌঁছালে শোকের মাতম উঠে। শনিবার তার দাফন সম্পন্ন হয়।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার বাড্ডার লিংকরোড এলাকার ফুপাতো ভাই মনির মোল্লার 'হাসান স্টিল অ্যান্ড ফার্নিচার' এ কাজ করতো শিহাব। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মনির মোল্লার বোনের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে যান শিহাব। এ সময় কোটা বিরোধী আন্দোলন চলছিল। খাবার শেষ করে কারখানাতে যাওয়ার সময় রাস্তা পার হতে গেলে টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় সড়ক। এসময় একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় শিহাবের শরীরে। পরে খবর পেয়ে ফার্নিচার দোকানের মালিক ফুপাতো ভাই মনির মোল্লা স্থানীয় এক হাসপাতালে গিয়ে শিহাবকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে বনশ্রী এলাকার নাগরিক স্পেশালাইজড প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মনির মোল্লা বলেন, শিহাব আমার দোকানে কাজ করতেন। দুপুরে খাবার খেয়ে কারখানায় ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বুকের এক পাশ থেকে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায় তার। হাসপাতালে চিকিৎসা পায়নি। ভর্তি করতে চায়নি কোনো হাসপাতাল! চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে গেল।
নিহত শিহাবের বাবা শাহ আলম হাওলাদার বলেন, আমাদের পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল শিহাব। আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিল শিহাব।
জানতে চাইলে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। আমি খোঁজ খবর নিচ্ছি। সব কিছু স্বাভাবিক হলে ওই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা হবে।
আইএ