নোয়াখালী: পেশায় ট্রাক চালক। বাবা গাড়ি চালক। সে সুবাদে থাকেন ঢাকায়। সে দিন দুপুরে খাবার খেয়ে ফোন দেওয়ার কথা ছিল স্ত্রী সুলতানা আক্তারকে। ফোন না দিলেও মামুন ঠিকই ফিরে এসেছেন স্বশরীরে। তবে জীবিত মামুন নয়, ফিরলেন মৃত মামুন হোসেন (২৮)। সে আর কোনো দিন খোঁজ নিবে না তার তিন বছরের ছেলের। এর আগে ঢাকার রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় তার। স্বামীর সঙ্গে শেষ কথাটুকু বলতে না পারার আক্ষেপটা সারা জীবনই বয়ে বেড়াতে হবে স্ত্রী সুলতানাকে।
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯ জুলাই বিকেলে ঢাকার মহাখালী ফ্লাইওভারে। তখন ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। আর ওই পথ দিয়ে ফ্লাইওভার পার হওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান মামুন হোসেন। নিহত মামুনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের জালিয়াল গ্রামে।
রোববার সকালে তার গ্রামের বাড়িতে ঢুকতেই বাড়ির সবার মধ্যে নিরবতা আর আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অনেকটাই নির্বাক মামুনের বাবা-মা। স্বামীর শোকে অনেকটা পাথর বনে গেছেন স্ত্রী সুলতানা আক্তার। মামুনের সাড়ে তিন বছরের ছেলে মো. মুছাব হাসান এখনও জানে না তার বাবা আর কখনও ফিরবে না।
সে দিন কি ঘটেছিল জানতে চাইলে মামুনের বাবা জানান, ১৯ জুলাই বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তার ছেলে মামুন। হঠাৎ একটি গুলি মামুনের পেছন দিয়ে পেটের ডান পাশে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সড়কে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তখন ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। মামুনকে লুটিয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে আসেন আশপাশের পথচারীরা। তারা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
পরে একজন ফোন করে জানলে আমি খবর শুনে ছুটে যাই ওই হাসপাতালে। সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার পরিস্থিতি তখন এতটাই খারাপ, চিকিৎসা করানোর মতো কোনো অবস্থা ছিল না। পরে মামুনকে নিয়ে যাই মহাখালীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও মেলেনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। অনেক চেষ্টা করেও কোনো চিকিৎসককে হাসপাতালে আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। পরে আমার ছেলে বিনা চিকিৎসায় শুক্রবার রাত তিনটায় ওই হাসপাতালে মারা যায়। কথাগুলো বলতেই তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল বারবার।
স্বামীর বিষয়ে জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মামুনের স্ত্রী সুলতানা আক্তার বলেন, শেষবার যখন কথা হয়, তখন আমার স্বামী বলেছিলেন যে ঢাকায় অনেক গণ্ডগোল হচ্ছে। তাই তিন দিন ধরে বাইরে বের হতে পারছেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার দিন পর বাড়িতে আসবেন; কিন্তু সেই আসা আর হলো না। এর আগে স্বামীর লাশ দেখতে হয়েছে তাকে। এখন একমাত্র অবুঝ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার যত চিন্তা। বাবা মারা গেছেন, এটুকু বোঝার বয়সও হয়নি তার। এ অবস্থায় কি সান্ত্বনা দিব? কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সুলতানার শাশুড়ি ফাতেমা খাতুন বলেন, বাড়িতে ঘরের ভিটা ছাড়া তাদের কোনো জায়গা নেই। চার ছেলের তিনজনকে বিয়ে করিয়েছেন। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে অনেক কষ্ট করে ছেলে, ছেলের বউ, নাতিদের নিয়ে থাকতে হয়। আশা ছিল, ছেলে ট্রাক চালিয়ে বাড়তি রোজগার করবেন এবং পরিবারের হাল ধরবেন। কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে গেছে। ছোট্ট নাতির দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়। সে কাকে বাবা বলে ডাকবে? আমরা তাকে কি বলব।
নিহত মামুনের লাশ ২০ জুলাই সকালে নিয়ে আসা হয় নোয়াখালীর নিজ বাড়িতে। বিকেলে গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে মামুনের লাশ দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে।
এমএস