• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

‘আমার বাজানরে কি আর ফিইরা পামু, আমার বাজান কই গেলগা!’ 


শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জুলাই ২৯, ২০২৪, ১১:৫২ এএম
‘আমার বাজানরে কি আর ফিইরা পামু, আমার বাজান কই গেলগা!’ 

শিবচর: ‘কে গুলি করল আমার বাজানরে? কেন গুলি করল! আমার বাজান তো আন্দোলনে যায় নাই। কার কাছে বিচার চামু, কেডা বিচার করব! কার বিরুদ্ধে বিচার চামু? আমার বাজানরে কি আর ফিইরা পামু! আমার বাজান কই গেলগা! আমার আর কেউ রইল না জগতে। আল্লার কাছে বিচার দিলাম, আল্লাহ, আমার বাজানরে যারা গুলি করে মারছে তাদের তুমি দেখছ, তুমিই বিচার কইরো।’

গত শনিবার বিকেলে নিজ বাড়িতে বসে কথাগুলো বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় গুলিতে নিহত হওয়া হৃদয় হোসেন সিহাবের (১৮) মা নাসিমা বেগম। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরের সন্ন্যাসীর চর ইউনিয়নের আজগর হাওলাদারের কান্দি এলাকায়। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর বাড্ডার লিংকরোড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন সিহাব।

নিহত সিহাব দিনমজুর শাহআলম হাওলাদারের একমাত্র ছেলে। দুই ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন ছোট। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক বাবা। কারও সঙ্গেই কথা বলতে পারছেন না। মানুষ দেখলে শুধু চেয়ে থাকেন। কখনো বাড়ির উঠানে হাঁটেন, কখনো আবার বাড়ির বাইরের রাস্তার এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ান। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেন না।

গত শনিবার বিকেলে নিহত সিহাবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনদের অনেকেই সিহাবের মাকে সান্ত¡না দিতে ব্যস্ত। আবার কেউবা যাচ্ছেন সিহাবের কবরস্থানে। এ সময় সিহাবের মাকে আহাজারি করে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বাবার তো কোনো দোষ ছিল না। কেন বাবারে গুলি করল? কেন বাবারে মাইরা ফেলল? বাবায় কয়দিন আগে বলে, কাজ পুরোপুরি শেখা হলে বিদেশ যাইব। আমি পাসপোর্ট কইরা দিব বলছিলাম। আর পাসপোর্ট করতে হইব না। আমার বাবায় আর আইব না। আমারে মা বইলা ডাকব না। আল্লাহ তুমি এইয়া কী করলা। আমার মানিককে কেন কাইড়া নিলা? ওর তো কোনো দোষ নাই।’

স্বজনরা জানান, স্থানীয় রাজারচর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন সিহাব। তার বাবা শাহ আলম কখনো দিনমজুরের কাজ, আবার কখনোবা গাড়ি চালিয়ে যা আয় করতেন, তা দিয়ে সংসারের অভাব ঘোচাতে হিমশিম খেতেন। তাই পরিবারের সবার সম্মতিতে ২০২২ সালের প্রথম দিকে দূরসম্পর্কের ফুপাতো ভাই মনির হোসেনের মালিকানাধীন বাড্ডার লিংকরোড এলাকার ‘হাসান স্টিল অ্যান্ড ফার্নিচার’ নামে একটি দোকানের কারখানায় আসবাবপত্রের কাজ শিখতে পাঠানো হয় সিহাবকে। সেখানে গত আড়াই বছর ভালোভাবেই কাজ শিখছিলেন। ইচ্ছে ছিল আগামী বছরের শুরুতে পাসপোর্ট করে কাজের জন্য বিদেশে যাওয়ার।

কারখানায় কাজের জন্য একই এলাকায় দোকান মালিক মনিরের বোনের বাসায় তিনবেলা খেতেন সিহাব। গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর ওই বাসায় খেয়ে কারখানায় ফেরার পথে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন। রাস্তায় শুয়ে পড়ে নিজের পরনের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গুলি লাগা জায়গায় বেঁধে শরীরের রক্তঝরা বন্ধের চেষ্টা করেন সিহাব। এরই মধ্যে নিস্তেজও হতে থাকেন। এ সময় সিহাবকে চিনতে পেরে ওই এলাকার লোকজন দোকান মালিক মনিরকে জানান। পরে স্থানীয় লোকজন ওই এলাকার নাগরিক স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সিহাবকে মৃত ঘোষণা করেন।

দোকান মালিক মনির হোসেন বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরে খাওয়া শেষে দোকানে ফিরছিল সিহাব। আমি বাসায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে একজন ফোন দিয়ে আমাকে বলে যে আপনার লোক গুলি খাইছে, দ্রুত আসেন। পরে আমি সেখানে যাই। গিয়ে শুনি সিহাবকে লোকজন বাড্ডার একটি হাসপাতালে নিয়েছে। পরে আমি সেখানে যাই। সেখানে তারা বলে রোগীর অবস্থা ভালো নয়, ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান, পরে সেখান থেকে নাগরিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা বলে সিহাব মারা গেছে।’

সিহাবের বোনের স্বামী নীরব হোসেন বলেন, ‘দুপুরের খাবার খেয়ে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয় সিহাব। সন্ধ্যার দিকে আমরা খবর পাই। পরে লাশ আনতে আনতে রাত ১১টা বেজে যায়।’

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বিষয়টি আজ (গত শনিবার) আমি জেনেছি। এ বিষয়ে ডিসি স্যারের সঙ্গে আলোচনা করব, দেখি কোনো সহায়তা করা যায় কি না।’

এমএস

Wordbridge School
Link copied!