লক্ষ্মীপুর: গত কয়েকদিন ধরে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলার বাসিন্দারা। বন্যার ফলে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে ভুগছেন মানুষজন। বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তীত থাকায় পানিবন্দি বাসিন্দাদের মাঝে দেখা দিচ্ছে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন পানি বাহিত রোগের প্রকোপ। পানি কমতে শুরু করলেও দুর্বিষহ দিন কাটছে তাদের। আশ্রয়ণ কেন্দ্রসহ হাসপাতাল গুলোতে বেড়েছে রোগীর চাপ। শয্যা সংকটে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন মেঝেতে। আক্রান্তদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নার্সসহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
এদিকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে কলেরা স্যালাইন, সিরাপ সালফুটামল, হিসটাসিন ও ডায়রিয়া এনটিভয়োটিকসহ ওষধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বাধ্য হয়ে বাহিরে থেকে স্যালাইনসহ ঔষধ কিনতে হচ্ছে এসব সরকারি হাসপাতালের রোগীদের।
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা নেই। এক একটি বেডে গাদাগাদি করে ২/৩ জন করে ভর্তি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেক রোগীই বেডে জায়গা না পাওয়ায় মেঝেতেই বিছানা পেতে সারিবদ্ধভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অপর্যাপ্ত নার্স সংকটে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভীড় ঠেলে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
ডায়রিয়ার ওয়ার্ডের ব্রাদার নোমান হোসেন বলেন, ১০ বেডের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বর্তমানে ভর্তি আছে ৯৫ জন রোগী। এক-দুজন নার্স দিয়ে এতো গুলো রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা খুবই কষ্টকর। একজনের স্যালাইন লাগাতে গেলে- দশ জন ডাকে ওষধ দিতে। তার উপরে স্যালাইন ও ডায়রিয়া এন্টিভায়টিক ওষধ সংকট। এখন রোগীর স্বজনরা বাহির থেকে কিনে আনলে তাদিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে নিচ্ছি।
গত ২ দিন ধরে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে একই বেড ভাগ করে আরও দুই রোগীর সাথে ৭ মাসের শিশু মিরাজকে নিয়ে ভর্তি আছেন মান্দারি ইউনিয়নের বাসিন্দা তাসলিমা আক্তার। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, গত ১০দিন ধরে বাড়িতে কোমর সমান পানিতে বন্দি আছি। টয়লেট ও ডোবার নোংরা ময়লা বন্যার পানিতে একাকার। এখন আমার ৭ মাসের ছেলের জ্বর ও ডায়রিয়ায় খুব খারাপ অবস্থা। সরকারি হাসপাতেল এসে আরো অস্বস্তিতে পড়েছি। গুদাম ঘরের মত পরিস্থিতি।
একই কথা বললেন শহরের মুক্তিগঞ্জ থেকে শিশু কন্যা তাসুকে ভর্তি করিয়েছেন দিনমুজুর খোকন। তিনি বলেন, বন্যার পানি পচে চারদিকে ডায়রিয়াসহ নানা রকমের অসুখ দেখা দিয়েছে। আমার ১০ বছরের মেয়ের ডায়রিয়ায় খুব খারাপ অবস্থা। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েও স্যালাইনসহ সব ঔষধই বাহিরের ফার্মেসী থেকে কিনতে হচ্ছে। কিছু বললে নার্সরা বলে ঔষধ নাই কোথায় থেকে দিবো?
চর লরেন্স থেকে আসা সামছুন নাহার, সদরের চৌধুরী বাজার এলাকা থেকে আসা ইমন সহ কয়েকজন রোগীর স্বজন জানান, হাসপাতালের ওয়ার্ডে জায়গাই পাচ্ছেন না তারা। তবুও চলাচলের স্থানে বিছানা পেতে আছে, ময়লা দুর্গন্ধ আর রোগী ভীড়ে খুবই খারাপ অবস্থা। চিকিৎসা সেবা নেই বলেই চলে।
ডায়রিয়া বিভাগের ইনচার্জ লিলু রানী দাস বলেন, গত ৩ দিনে প্রায় ৩ শতাধিক ডায়রিয়া ও জ্বর নিয়ে রোগী ভর্তি হয়েছে। যেভাবে রোগী ভর্তি হচ্ছে তারা সবই বন্যাক্রান্ত এলাকার। গত শুক্রবার ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩২জন ভর্তি হলেও গত ৩/৪ দিনে গণ হারে ডায়রিয়া, জ্বর নিয়ে রোগী ভর্তি হচ্ছে। ১০ জনের বেড তো খালি নেই। মেঝেতেও হাটার জায়গা নেই। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে, কলেরা স্যালাইন, সিরাপ সালফুটামল, হিসটাসিন ও ডায়রিয়া এনটিভয়োটিকসহ ওষধের তীব্র সংকট। যেতুটু ছিলো সব রোগীদের সমহারে বন্টন হচ্ছে। রোগীরা এখন বাহির থেকে ঔষধ কিনছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে জেলার ৫টি উপজেলার বন্যাক্রান্ত ৪শ' আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ডায়রিয়া, জ্বরসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মেডিকেল টিমের কর্মীরা চিকিৎসক দিলেও তা অপযাপ্ত। এতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আশ্রয়ন কেন্দ্রের বাসিন্দাসহ স্থানীয়রা।
লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন আহম্মদ কবির জানান, বন্যার কারণে ডায়রিয়াসহ চারদিকে পানি বাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে শুরু থেকে আশ্রয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬৪টি মেডিকেল টিমের সদস্যরা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। তবে হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ায় কলেরার স্যালাইন সহ ওষধের সংকট দেখা দিয়েছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দু-তিন দিনের মধ্যে স্যালাইনসহ ঔষধ সরবরাহ করা হলে সংকট নিরসন করা হবে বলে জানান তিনি।
এসএস