• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
১০ বছরে ১৪০ মৃত্যু

এক দুর্ঘটনায় প্রশ্নের মুখে জাহাজভাঙা শিল্প


চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪, ০৩:১৯ পিএম
এক দুর্ঘটনায় প্রশ্নের মুখে জাহাজভাঙা শিল্প

চট্টগ্রাম : শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় ১২ জন আহত ও এ পর্যন্ত একজনের মৃত্যুতে তোলপাড় চলছে দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে। এস এন কর্পোরেশনের ইয়ার্ডটি গ্রিন শিপ ইয়ার্ড আধুনিক উপকরণে সমৃদ্ধের পরও কেন দুর্ঘটনা ঘটলো?

এ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও ইয়ার্ড মালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

২০১৬ সালে দেশের প্রথম গ্রিন শিপ ইয়ার্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পিএইচপি শিল্পগ্রুপের ইয়ার্ডটি। আর এই ইয়ার্ডের দেখাদেখি পর্যায়ক্রমে আরো চারটি শিপ ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে সার্টিফাইড হয়। এর বাইরে আরো ১৫টি শিপ ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে রূপান্তরের সর্বশেষ স্তরে রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ২০টি শিপ ইয়ার্ড হংকং কনভেনশনের আদলে ইয়ার্ড তৈরিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা কেন ঘটলো?

জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ে গত ২০ বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে ও পলিসি পর্যায়ে কাজ করছেন উন্নয়ন সংস্থা ইপসার মোহাম্মদ আলী শাহীন।

তিনি মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) বলেন, ‘ইয়ার্ডগুলোতে দক্ষ জনবল, প্রশাসনের নজরদারির অভাব ও কার্যকর পরিদর্শন না হওয়ায় আধুনিকায়ন হলেও দুর্ঘটনা কমছে না। তবে ২০২০-এ দুর্ঘটনা কিছুটা কমে এলেও সর্বশেষ এস এন ইয়ার্ডের মতো আধুনিক ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় জাহাজভাঙা শিল্প খাতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।’

এই চিন্তার কথা স্বীকার করেছেন পিএইচপি শিপ ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম রিংকু। তিনি বলেন, ‘ এই দুর্ঘটনাটি আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আধুনিক ইয়ার্ডগুলোতে আমরা যন্ত্রপাতির পরিমান বাড়িয়ে জনবল কমিয়ে এনেছি। আমার ইয়ার্ডে আগে সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক কাজ করতো, এখন করে মাত্র ৩৫০ জন। এভাবে আধুনিক ইয়ার্ডগুলোতে জনবল কমানো হচ্ছে এবং ইকুইপমেন্ট বাড়ানো হচ্ছে।’

এই দুর্ঘটনা কেন ঘটেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাহাজ কাটার স্থলে কিন্তু দুর্ঘটনা হয়নি। যেখান থেকে কাটা হচ্ছে সেখান থেকে আগুনের টুকরো এসে পড়েছে এই স্থানে। আর তখনই বিস্ফোরণ হয়েছে। যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে সেখানে অন্য কাজ চলছিল।

তাহলে কি এমন কারণে দুর্ঘটনা হলো তা জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজেও কয়েক দফায় স্পটে গিয়েছি। তিনটি তদন্ত কমিটির সাথেই আমি জড়িত রয়েছি। যে স্থানে বিস্ফোরণ হয়েছে সেই স্থানটিতে গ্যাস তৈরি হচ্ছিল। কাটিংয়ের আগে কোনো গ্যাস ছিল না। পরবর্তীতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছিল এবং পাশের স্পট থেকে আগুনের টুকরো এসে পড়ায় তা বিস্ফোরিত হয়।’

বর্তমানে সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারির শিপ ইয়ার্ডগুলোতে কাটিংয়ের জন্য বাল্ক জাহাজ বেশি আসে। কিন্তু দুর্ঘটনা সংগঠিত জাহাজটি ছিল অয়েল ট্যাংকার। সাধারণত জাহাজ কাটিংয়ের আগে জাহাজটি সম্পর্কে প্রায় এক মাস স্টাডি করা হয় বলে জানান কে আর শিপ ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসলিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘এমনকি জাহাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরীক্ষার জন্য মালয়েশিয়ার একটি ল্যাবেও পাঠানো হয়। জাহাজ কাটিংয়ের আগে কোন অংশের পর কোন অংশ কাটা হবে তা প্রতিদিন ব্রিফ করা হয়। তারপরও এমন একটি দুর্ঘটনা আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।’

তবে হংকং কনভেনশন অনুযায়ী আমাদের ইয়ার্ডগুলোতে দ্রুত উপযোগী করে প্রস্তুত করতে হবে বলে মত দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক হাসান হাছিবুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সবাইকে সতর্ক হতে হবে। ব্যবসায়ীক মনোভাব বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশ দুষণ কমিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় আগামী বছরের ২৫ জুন থেকে হংকং কনভেনশন অনুযায়ী সব ইয়ার্ড চালু রাখা কঠিন হয়ে যাবে।’

তবে এই দুর্ঘটনা থেকে ইয়ার্ড মালিক ও শ্রমিকদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে জানান জনতা শিপ ইয়ার্ডের প্রধান নির্বাহী হোসাইনুল আরেফিন। তিনি বলেন, ‘আধুনিক শিপ ইয়ার্ডে এটাই প্রথম দুর্ঘটনা। এই ইয়ার্ডেও যেহেতু দুর্ঘটনা ঘটলো তাই দুর্ঘটনার পুরো কারণ তদন্ত পূর্বক তা ট্রেনিং ম্যানুয়েল আকারে তৈরি করতে হবে। আর এই ম্যানুয়েল শিপ ইয়ার্ডের শ্রমিকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত করতে হবে। একইসাথে মালিকদেরও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। এতে উপকৃত হবে জাহাজভাঙা শিল্প খাত।’

হোসাইনুল আরেফিনের সাথে একমত পোষণ করে পিএইচপি শিপ ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, ‘আমরা আমাদের শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। ইয়ার্ডের সব শ্রমিক এখন প্রশিক্ষিত। এই দুর্ঘটনার বিস্তারিত কারণও ম্যানুয়েল আকারে সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।’

সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারি এলাকায় গড়ে উঠা জাহাজভাঙা শিল্পে আগে সনাতন পদ্ধতিতে জাহাজ কাটা হতো। তখন প্রতিবছর দুর্ঘটনা ঘটতো ও মানুষ মারা যেতো। একসময় ১৫০টির বেশি ইয়ার্ড থাকলেও এখন ৩০ থেকে ৩৫টিতে নেমে এসেছে। এসব ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় গত ১০ বছরে ১৪০ জন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

উন্নয়ন সংস্থা ইপসা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ৯ জন, ২০১৫ তে ১৬, ২০১৬ সলে ১৭, ২০১৭ সালে ১৫, ২০১৮ সালে ২০, ২০১৯ সালে ২২, ২০২০ সালে ১১, ২০২১ সালে ১৪, ২০২২ সালে ১০, ২০২৩ সালে ৫ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালে গত শনিবারের ঘটনায় একজন মারা গিয়েছে।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!