• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

‘আন্দোলন গিয়ে শহীদ হবো, তুমিও আমার মেয়েকে নিয়ে আন্দোলনে যাও’


জামাল উদ্দিন বাবলু, লক্ষ্মীপুর সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪, ০৫:৫৪ পিএম
‘আন্দোলন গিয়ে শহীদ হবো, তুমিও আমার মেয়েকে নিয়ে আন্দোলনে যাও’

দুই সন্তানকে নিয়ে বিবি সালমা। ইনসেটে নিহত মাসরুর। ছবি-সোনালীনিউজ

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারী ইউনিয়নের আবদুল খালেকের বড় ছেলে মাযহারুল ইসলাম মাসরুর (২৯)। বাস করতেন রাজধানীর পার্শ্ববর্তী গাজীপুর এলাকায়। সেখানে ভাড়া বাসায় থেকে শ্বশুরের ব্যবসা দেখভাল করতেন তিনি। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে গাজীপুরের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন মাসরুর। সেখানে যাবার আগে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বিবি সালমা আক্তারের সাথে মুঠোফোনে কথা বলেন তিনি। এসময় মাসরুর তার স্ত্রীকে বলেন, ‘আমি আন্দোলনে যাচ্ছি। আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হবো! তুমিও আমার মেয়েকে নিয়ে আন্দোলনে সরিক হও, যদি পুলিশ গুলি করে তখন তুমি থাকে সামনে দিও।  যদি সে পুলিশের গুলিতে মারা যায়, তখন সবাই বলবে আমরা শহিদের বাবা-মা। আর যদি আমি আগে মারা যাই তখন তোমরা শহীদের স্ত্রী-মেয়ে।’

মাসরুর যখন প্রিয়তমা স্ত্রীকে এই কথা বলছিলেন, তখন কে জানতো তার সে চাওয়া বিধাতা পূরণ করতে চলছেন? স্ত্রীর সাথে ফোন রেখেই আন্দোলনে গিয়েছিলেন মাসরুর। আর সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার।

নিহত মাসরুর স্থানীয় একটি কাওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। স্থানীয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতির সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি।  তার নাফিজা আক্তার সাড়ে ৩ বছরের এক মেয়ে ও চারদিন বয়সী এক ছেলে রয়েছে। 

মাত্র চারদিন আগে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন মাসরুরের স্ত্রী বিবি সালমা। মঙ্গলবার সোনালীনিউজের প্রতিবেদক সরেজমিনে গিয়েছিলেন মাসরুরের গ্রামের বাড়িতে। এসময় কান্নাজনিত কণ্ঠে বিবি সালমা সোনালীনিউজকে বলেন, ‘সেদিন আন্দোলনে যাবার আগে তিনি (মাসরুর) মোবাইলে ফোন করে বলেছিলেন তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন। আর দেশের জন্য শহীদ হতে চান। উনার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। সত্যিই তিনি গুলি খেয়ে নিহত হয়েছেন। তবে তার আর শহিদের বাবা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না। মাসরুর দেশের জন্য শহীদ হয়েছে, এখন আমি বিধবা ও আমার মেয়ে এবং নবজাতক ছেলে এতিম হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ২টি সন্তান। ছাত্র আন্দোলনে আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়ার পর এখন আমি দিশেহারা। ছোট ছোট এই সন্তানদের নিয়ে আমি এখন কোথায় যাবো, কী করব। কে আমার সন্তানদের দায়িত্ব নেবে? আমার পরিবার কি ভাবে চলবে আল্লাহ ভালো জানে। তিনিই সব বলতে পারবেন।’

তিনি বলেন, একজন স্ত্রীর কাছে স্বামী হারানোর বেদনা কত কষ্টের, তা বলে বুঝানো যাবে না। এরপরও আমার সান্ত্বনা- আমার স্বামী দেশের জন্য শহিদ হয়েছেন। আমি চাই আমার স্বামীর জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশ এবং সমাজ থেকে বৈষম্য দূর হোক।

মাসরুরের ছোট ভাই হুমায়ুন কবির সোনালীনিউজকে বলেন, আমার ভাই আমাদের পরিবারের হাল ধরেছে। সে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য করত। যখন আন্দোলন শুরু হয়েছে।তখন সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। যখনই তার সাথে কথা হতো, আন্দোলনে না যাওয়ার বলছি। সে বলতো, আমি আন্দোলনে না গেলে দেশ স্বাধীন করবে কে? পরে লংমার্চের দিন ৫ আগস্ট গুলিবৃদ্ধ হয়ে মারা যায় আমার ভাই।

মাসরুরের বৃদ্ধ বাবা আবদুল খালেক কান্না কন্ঠে সোনালীনিউজকে বলেন, আমার ছেলে আন্দোলনে গিয়ে মারা গেছেন। বাড়ীতে থাকলেও হয়তো মারা যেত। আল্লাহপাক নিয়ে গেছে। সে দীনের কাজে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। ছেলের বৌ, আমার নাতি- নাতিনীদের দেখা শোনা করবো আমরা। ছেলে যে সম্পদ পেতো তা দিয়ে দিবো নাতি- নাতিনীদের। 

মাসরুরের জেঠা শ্বশুর ওমর ফারুক সোনালীনিউজকে বলেন, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে আমার ভাইয়ের মেয়ের জামাই মারা গেছেন। তার পরিবার এখন আমাদের বাড়ী (মাসরুরের শ্বশুর বাড়ীতে) আছে। এখন মাসরুরের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের কি হবে আল্লাহপাক ভালো জানেন। আমার ভাতিজির ২টি সন্তান। স্বামীহারা এই মেয়ের এখন কী হবে, তা ভেবে কোনো কূলকিনার পাচ্ছি না। আমরা চাই সরকার এবং সমাজের বৃত্তবানরা এই এতিমদের পাশে দাঁড়াক।

প্রসঙ্গত, শহীদ মাযহারুল ইসলাম মাসরুর ঢাকার গাজীপুরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন।সেখানে শ্বশুরের ব্যবসা দেখভাল করতেন তিনি। এরই মধ্যে দেশে আন্দোলন শুরু হলে গত ৫ আগস্ট তিনি গাজীপুরে ছাত্রদের সাথে মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন মাসরুর। পরে গাজীপুর শহীদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মারা যান তিনি। ৬ আগস্ট তার মরদেহ বাড়ীতে আনার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

এসএস

Wordbridge School
Link copied!