কুড়িগ্রাম: বিবিসির প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় জায়গা পেয়েছেন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রিকতা আখতার বানু লুৎফা। বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে স্থান পেয়েছেন তিনি। বিবিসির এই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এমন সব নারীকে জায়গা দেওয়া হয়, যারা কঠিন পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসেন।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের দক্ষিণ ধনঞ্জয় গ্রামের মৃত নুর মোহাম্মদের কন্যা রিক্তা আখতার বানু লুৎফা। তিনি চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের রমনা সরকারপাড়া গ্রামের আবু তারিক আলমের স্ত্রী। পেশাগত জীবনে চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ নার্স রিকতা। স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন সরকারপাড়া গ্রামে।
জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে চিলমারী জনপদ। সময়ের সাথে সাথে খানিকটা বদলে গেলেও এখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিশাপ হিসেবেই দেখা হয় এখনো। তারা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হয় সমাজে। রিকতাও তার সন্তান নিয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত তার কন্যাসন্তানকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাকপ্রতিবন্ধী সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতে না পেরে নিজেই স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন রিকতা আখতার বানু। এ কাজে জমি দান করেন তার স্বামী। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন দেবরসহ আরও কয়েকজন। দোচলা টিনের ঘর তুলে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে হলেও প্রথম বছরেই পেয়ে যান ৬৩ জন শিক্ষার্থী। ধীরে ধীরে গত ১৫ বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে ২৯৪ জনে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামে শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন তিনি।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১০০ গুরুত্বপূর্ণ নারীর সঙ্গে নিজের নাম থাকায় আনন্দিত রিকতা আখতার বানু লুৎফা বলেন, ‘আমার মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মনি একজন বাকপ্রতিবন্ধী। ২০০৮ সালে তাকে স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করি। কিন্তু কিছুদিন পরে শিক্ষকেরা প্রতিবন্ধী শিশুকে পড়াবেন না বলে স্কুল থেকে তাকে বের করে দেন। অনেক অনুরোধ করেও আমার মেয়েকে সেখানে আর পড়ানোর অনুমতি পাইনি।
রিকতা আখতার বলেন, ‘আমার মেয়ের সাথের শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়া দেখে সে কান্নাকাটি কারত। নিজেই নিজের হাত-পায়ে কামড় দিত। পরে মেয়ে ও সমাজের অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্কুল চালু করি।’
তিনি আরও বলেন, বিদ্যালয় শুরুর প্রথম বছরে উপজেলার ৬৩ জন প্রতিবন্ধী শিশু ভর্তি হয়। এ কাজে তার স্বামী ২৬ শতক জমি দাম করেন। ওই জমিতে দোচালা টিনের ঘর নির্মাণ করে বিদ্যালয় শুরু করেন। কিন্তু বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষক পাওয়া। এসব প্রতিবন্ধী শিশুদের কেউ পড়াতে চাইতেন না। পরে তার ব্যাকুলতা দেখে দেবর পড়াতে রাজি হন। একে একে আরও চারজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় শুরু করেন। বর্তমানে এই প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২৯৪ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার পরিবর্তে বের করে দেয় সেখান থেকে আমার মাথায় প্রতিবন্দী মেয়েদের শিক্ষার জন্য জেদ চেপে বসে। সেখান থেকেই নিজ নামে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় স্থানের উদ্যোগ। মেয়ের কারণে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নারীদের তালিকায় আমাকে স্থান দিয়ে সম্মানিত করেছে বিবিসি। আমি আপ্লুত। এই কৃতিত্ব শুধু আমার একার নয়। বিবিসি পরিবার, আমার জেলার সংবাদকর্মীসহ আমার কাজে উৎসাহ দেওয়া সকলের।
প্রাথমিকভাবে অটিস্টিক কিংবা শিক্ষণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এমন শিশুদের জন্য স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করলেও, বর্তমানে রিকতার স্কুলটিতে বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরাও প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে।
এসএস