বরগুনা: পাথরঘাটায় যুবদলকর্মী নাসির হাওলাদারকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ক্রমশ বিতর্ক বেড়েই চলেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা রাব্বি ও তার অন্যতম সহযোগী হাসানকে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী বলে পরিচয় দেয়া হলেও তাদের গলায় ঝুলতে দেখা গেছে পাথরঘাটা উপজেলা জামায়াতের একটি অনুষ্ঠানের ডেলিকেট কার্ড। এছাড়া গত ৫ আগস্টের পর বিএনপির এক মিছিলে তাদের স্বপক্ষে মিছিলের একটি ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে বরগুনা জেলা যুবদল নেতারা বলছেন অভিযুক্তরা আগে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগেরকর্মী ছিলো এখন শিবিরের সাথে জড়িত। তবে তাদের প্রেস রিলিজে খুনীদের ছাত্রলীগের কর্মী বলে উল্লেখ করেছে।
অন্যদিকে ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে যুবদল মিথ্যাচার করছে অভিযোগ করে জেলা জামায়াত ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করেছে। সেখানে রাব্বি ও হাসানকে তাদের কর্মী নয় বরং তারা অন্যকোন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য বলায় শুক্রবার (৩ জানুয়ারী) সন্ধ্যায় বরগুনা প্রেসক্লাবে তার প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ বরগুনা জেলা শাখা।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি মুফতি ওমর ফারুক বলেন যুবদল কর্মী নাসিরের খুনের সঙ্গে জড়িত রাব্বি ও হাসান তাদের কোন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। অন্যদিকে বরগুনা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি নিজের ফেসবুক ওয়ালে এই ঘটনায় অভিযুক্তদের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে বিবৃতি দিয়েছেন।
যুবদল নেতা নাসির হাওলাদারের হত্যার ঘটনায় নিহতের বোন রুমী আক্তার বাদী হয়ে পাথরঘাটা থানায় ৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে ইতোমধ্যে মাহবুব নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পাথরঘাটা পুলিশ।
মামলার এজাহারে উল্লেখিত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন পাথরঘাটা পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের ইউনিট সভাপতি ঈসা রুহুল্লাহ (৩৮), পৌর ছাত্রশিবির সভাপতি কাইউম (২৪), আব্দুস সালাম মুন্সী (৫৫), হাসান (২৫), ইব্রাহিম (১৯), আবু সাঈদ (২৩), রাব্বি (১৯) ও তার বাবা মাহবুব (৫২)।
এদিকে যুবদল নেতা নাসির হত্যাকান্ডের ঘটনায় অভিযুক্তরা ছাত্র শিবির নাকি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সদস্য তা নিয়ে চলেছে রাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে বিভিন্ন মন্তব্য। ঘটনার পরপরই পাথারঘাটা ছাত্রশিবিরের নেতা কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
তবে প্রথমে হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্তদের নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সদস্য বললেও পরবর্তীতে বরগুনা যুবদলের অনেকেই বলেছেন তারা শিবিরের কর্মী। আর এ অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৭ টার দিকে বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামি বরগুনা জেলা শাখার নেতাকর্মীরা।
সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে জামায়াত ইসলামীর নেতাকর্মীরা বলেন, যুবদল নেতা নাসির হত্যার ঘটনায় ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। এ ঘটনায় পাথরঘাটা উপজেলার দক্ষিণ শাখার সভাপতি হাফেজ মো. রাকিব হাসানের ওপর হামলাও করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে সংকটাপন্ন অবস্থায় বরিশালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বরগুনা জেলা শাখার আমীর অধ্যাপক মাওলানা মুহিবুল্লাহ হারুন সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, পাথরঘাটা উপজেলায় গত ১ জানুয়ারী যুবদলের কর্মী মো. নাসির হত্যাকাণ্ডের যে ঘটনা ঘটেছে তা দুটি পক্ষের মধ্যে পূর্ব শত্রুতার জেরে হয়েছে।
যার বাস্তব সাক্ষী এলাকাবাসী এবং পাথরঘাটার স্থানীয় সংবাদকর্মীগণ। তবে পাথরঘাটার একটি রাজনৈতিক দলের কিছু কর্মী ও নেতৃবৃন্দ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করতে চাচ্ছে। এ কারণে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী বলে চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চেষ্টা চালানো হয়েছে।
অপরদিকে প্রথমে অনেকেই অভিযুক্তদের ছাত্রলীগের সদস্য বলায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল করিম রেজা তার ফেইসবুক প্রফাইলে একটি প্রতিবাদ লিপি পোস্ট করেছেন।
তিনি লিখেছেন যুবদল কর্মী নাসিরকে পায়ের রগ কেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। উক্ত ঘটনায় অভিযুক্ত হত্যাকারী হাসান ও রাব্বি ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত থাকার মিথ্যা বিভ্রান্তিমূলক তথ্যা ছড়ানো হচ্ছে।
আমরা পরিস্কার করে বলছি হত্যাকারী বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের কোনো ইউনিটের সদস্য বা কোনো রকম সম্পৃক্ত নয়।
হত্যাকান্ডের ঘটনায় বরগুনার জেলা যুবদলের সভাপতি জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেন, আমাদের যুবদলের সাবেক নেতা নাসির হাওলাদারকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা। রাব্বি এবং হাসান স্থানীয় একটি দোকানে বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন। এ সময় নাসির তাদেরকে পাশে গিয়ে সিগারেট খেতে বলেন।
এ কথাকে কেন্দ্র করেই নাসির যখন গতকালকে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল তখন রাব্বি এবং হাসান সহ আরো কয়েকজন মিলে তাকে কুপিয়ে পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। আমরা শুনেছি শিবির রগ কাটা সংগঠন একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন। আমরা গতকালকে বরগুনার মানুষ দেখেছি ছাত্রশিবিরের কর্মী কি করতে পারে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
এ ঘটনায় নিহতের বোন রুমী আক্তারের দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করা হয়, নিহত নাসির হওলাদার পরিবারের অমতে গত ৪-৫ মাস আগে পাথরঘাটার ছোনবুনিয়া নামক এলাকায় ২য় একটি বিবাহ করে তার শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করতেন। গত ১ জানুয়ারি পাথরঘাটা পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের খাদ্য গুদাম সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে বসে অভিযুক্ত হাসান গাজী সিগারেট খাওয়ার সময় নাসির হাওলাদারের মুখে সিগারেটের ধোয়া দেয়। এ ছাড়াও গত ৫ তারিখের বিএনপি নেতা বলে উস্কানি দেয়।
একপর্যায়ে নিহত নাসিরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। পরে সেখানে উপস্থিত লোকজন বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে মীমাংশা করে দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাসির হাওলাদারকে তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে অভিযুক্ত আসামিরা পথিমধ্যে আটকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে এবং পায়ের রগ কেটে আহত করে। পরে স্থানীয়রা নাসিরকে উদ্ধার করে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়া গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নাসিরকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল বলেন, নাসির নামে যুবদল কর্মীকে হত্যার ঘটনায় ৮ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মূলত হাসান এবং রাব্বি নামে দুই যুবক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েই পালিয়ে যায়। অভিযুক্তরা আমাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে স্থান পরিবর্তন করায় তাদেরকে এখনো আমরা গ্রেপ্তার করতে পারিনি।
তবে আশা করি খুব দ্রুতই তাদেরকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পারব। অভিযুক্তরা কোন সংগঠনের জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত হাসান এবং রাব্বির বয়স খুবই কম এরা মূলত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলাফেরা করতো। এ কারণেই কেউ কেউ তাদেরকে ছাত্রলীগ আবার কেউ তাদেরকে শিবির বলে দাবি করছেন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ব্যক্তিগত রেষারেষিতেই ঘটেছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ১ জানুয়ারী বুধবার ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন শেষে শ্বশুর বাড়ী যাওয়ার পথে যুবদল নেতা নাসিরকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের ঘুটাবাছা নামক এলাকার নূরিয়া স্কুল সংলগ্ন সড়কে এ ঘটনা ঘটে।
এআর