ঢাকা: উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় তার ব্যাখ্যা দিতে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া সার্কেল) রাসেল মনির ও সদ্য প্রত্যাহার হওয়া পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে তলব করেছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে উচ্চ আদালতের জামিন পাওয়া আসামিদের কারাগারে পাঠানোয় শরীয়তপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করা হয়েছে। আগামী ১৬ জুলাই তাদের সশরীরে হাজির হতে বলা হয়েছে।
এছাড়া উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় পুলিশ মহাপরিদর্শককে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আনিসুর রহমান।
এর অগে সকালে এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে আবেদন করেন আইনজীবী মজিবুর রহমান। গত ১১ জুন বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী মজিবুর রহমান। তখন আদালত বলেন, লিখিত আবেদন দাখিল করুন। আমরা ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
শরীয়তপুর আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২৯ মে রাতে ওই চার যুবককে আটক করা হলেও ১ জুন তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করেন পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদ। আদালতে হাজির করার প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আটক করার সময় ওই চার যুবক ধস্তাধস্তিতে জখম হয়েছেন। তাদের জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ৪ জুন ওই চার আসামির জামিন ও রিমান্ড শুনানির দিন ছিল। ওই দিন আসামিপক্ষের আইনজীবী চারজনকে গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনের বিষয় আদালতের নজরে আনেন। আদালত তাদের চিকিৎসা দিয়ে মেডিকেল প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন। সদর হাসপাতাল থেকে ৬ জুন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন দেখাচ্ছেন ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সাদ্দাম চোকদার
মেডিকেল প্রতিবেদনের বিষয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সুমন কুমার পোদ্দার বলেন, ৪ জুন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান চার আসামিকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, তাদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
মেডিকেল প্রতিবেদনে নির্যাতনের সত্যতা পেয়ে শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান তা আদালতে নথিভুক্ত করেন। এরপর তিনি ৭ জুন এ বিষয়ে আদেশ দেন। ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ’ আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এরপর ৯ জুলাইয়ের মধ্য আমলি আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাজিরার আহাদী বয়াতিকান্দি গ্রামের শাহীন আলম শেখ ও তার সহযোগী ছোট কৃষ্ণনগর গ্রামের সেকান্দার মাদবরের কাছ থেকে গত ২১ মে ১৭ হাজার ডলার, টাকা ও মুঠোফোন ছিনতাই হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তাদের কাছ থেকে ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা খোয়া গেছে এমন অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা করেন শাহীন আলম। এতে বকুল চোকদার, মো. সাদ্দাম চোকদার, সাইদুল শেখ, মো. আনোয়ার হোসেনসহ ৯ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ২৯ মে তারা উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন পান। এরপর রাতে তারা ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাসায় ছিলেন। সেখানে তাদের ওপর চড়াও হন জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারী ও ছিনতাই মামলার বাদীর আত্মীয় শহীদুল ইসলাম। পরে রুবেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমানকে মুঠোফোনে কেরানীগঞ্জের ওই বাসায় ডেকে নেন। সেখানে একটি কক্ষে আটকে তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
এ ব্যাপারে জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারী বলেন, যার ডলার ও টাকা ছিনতাই হয়েছে, তিনি তার ভাগ্নে হয়। তাকে সহযোগিতা করার জন্য সামাজিকভাবে তিনি মামলার আসামিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। ঢাকায় তাদের অনুসরণ করে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। তখন ধস্তাধস্তিতে তারা ব্যথা পেতে পারেন।
আদালত পরিদর্শক মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার অভিযোগে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আমলি আদালত থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে। ওই আদেশের নথি বৃহস্পতিবার শেষবেলায় আমাদের কাছে পৌঁছায়। শুক্র-শনিবার বন্ধ থাকায় তা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠাতে পারিনি। আজ সকালে পাঠিয়েছি। ওই আদেশে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগী সাদ্দাম চোকদার বলেন, ‘আমাদের চোখ বেঁধে আটকে রেখে দুই দিন ধরে পিটিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে হাড় ও হাতপায়ের গিরায় পেটানো হয়েছে। প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে দেওয়া হয়েছে। আমার বাঁ চোখে লাথি মেরেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির।’
অপর বকুল চোকদার বলেন, ‘আমাদের পিটিয়েছে আর জিজ্ঞেস করেছে—টাকা কোথায় রেখেছিস? তোদের ৭২ লাখ টাকা দিতে হবে, তোরা টাকা নিয়েছিস, তা স্বীকার কর। চোখ বেঁধে দুজনকে আলাদা করে ফেলেছিল। দুজনকে এনকাউন্টারে দেওয়া হয়েছে বলে ভয় দেখানো হয়েছে। আমার চাচাতো ভাই সাদ্দামকে মেরে ফ্লোরে ফেলে রাখার পর সে পানি খেতে চেয়েছিল। তখন আমাকে ভাইয়ের মুখে প্রস্রাব করে দিতে বলে। আমি কান্না করি, আবার পেটায়। বাধ্য হয়ে ভাইয়ের শরীরে প্রস্রাব করে দিই।’
সোনালীনিউজ/এম