ঢাকা : প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রাখতে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করা হয় বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
তিনি বলেন, হাই কোর্টের রায় বাতিল চাইতে হলে আইন অনুযায়ী লিভ টু আপিল ফাইল করতে হয়; লিভ টু আপিল ফাইল করা হয়েছে।
আদালত শুনানির পর সিদ্ধান্ত দেবেন, আমাদের আপিলের অনুমতি দেবেন কি না। আমরা আবেদনে দেখিয়েছি কী কী কারণে হাই কোর্টের রায়টি সঠিক হয়নি। আদালতের কাছে আমাদের প্রার্থনা হচ্ছে, লিভ (আপিলের অনুমতি) দিয়ে হাই কোর্টের রায়টি যেন বাতিল করা হয়।
কেন আবেদন করেছেন জানতে চাইলে, অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমাদের মূল যুক্তিটা হচ্ছে এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। ফলে এতে আদালতের বিচারের কিছু নাই।
রোববার হাই কোর্টের ২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি–ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ, যদি থাকে, সব কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে সরকার চাইলে এর পরিবর্তন, কমানো বা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলেও রায়ে বলা হয়।
২০১৮ সালের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। সেই আবেদনের চূড়ান্ত শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল গত ৫ জুন।
সেই রায়ের অপারেটিভ বা বাস্তবায়নের অংশ প্রকাশিত হয় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়।
তার আগেরদিন বুধবার কোটার বিরোধিতায় আন্দোলনের মধ্যে সব পক্ষকে চার সপ্তাহ স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।
কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত ওইদিন বলেছে, কোটা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে আপিল বিভাগ আবার বিষয়টি শুনবে। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ৭ অগাস্ট।
হাই কোর্টের আংশিক প্রকাশিত রায়ে বলা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব কোটা বাতিল করে যে ২০১৮ সালে যে পরিপত্র সরকার জারি করেছিল, তা ‘অবৈধ এবং আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য যে কোটা সরকার বাতিল করেছিল, তা পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে। সেই সঙ্গে জেলা কোটা, নারী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা এবং উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতিগোষ্ঠীর জন্যও কোটা বহাল করতে হবে।
এই রায় পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোটা পুনর্বহালে আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দেয় আদালত।
সেই সঙ্গে হাই কোর্ট বলেছে, সরকার যদি ওইসব কোটার শতকরা হার বা অনুপাত বাড়াতে, কমাতে বা পরিবর্তন করতে চায়, এই রায় সেক্ষেত্রে কোনো বাধা হবে না।
পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে কোনো নির্ধারিত কোটা পূরণ না হলে সরকার মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দিয়ে সেই পদ পূরণ করতে পারবে।
হাই কোর্টের রায়ের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা। প্রথম কয়েক দিন মিছিল, মানববন্ধনের মত কর্মসূচি থাকলেও গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয় তাদের অবরোধ কর্মসূচি, যার নাম তারা দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলনকারীরা শুরুতে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করলেও এখন তাদের দাবি এক দফায় এসে ঠেকেছে।
তাদের দাবি হল- সব গ্রেডে সব ধরনের ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ‘ন্যূনতম পর্যায়ে’ এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে৷
আন্দোলনের অংশ হিসেবে রোববার গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালন ও রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। পরে তারা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।
ওইদিনই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে সরকারপ্রধান বলেন, কোটা আন্দোলন করার আগে তো তাদের রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল যে- কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে! দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ‘মর্মাহত’ হয়ে রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষালয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ দেখান; যেখানে স্লোগান দেওয়া হয়, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছ, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।
শিক্ষার্থীদের এমন স্লোগান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা মধ্যে সোমবার দফায় দফায় সংঘাত হয়েছে, আহত হয়েছেন প্রায় তিনশ জন। পরদিন মঙ্গলবার সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে চারজনের প্রাণহানির খবর মিলেছে।
এমটিআই