• ঢাকা
  • রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১

পুলপার্টিতে টার্গেট তরুণীরা


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ৮, ২০২১, ০২:০০ পিএম
পুলপার্টিতে টার্গেট তরুণীরা

ঢাকা : টিকটকের আড়ালে নারী পাচারের ভয়ংকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। বিভিন্ন পার্টির প্রলোভন দিয়ে সেখান থেকে বাছাই করা সুন্দরী তরুণীদের ফাঁদে ফেলে পাচার করত হূদয় সিন্ডিকেট।
বিশেষত ভারতে তরুণী নির্যাতনের ঘটনার পর বাংলাদেশে টিকটক হূদয়ের অন্যতম সহযোগী রাফি ওরফে রাফি বসসহ কয়েকজনকে আটকের পর বেরিয়ে আসছে নারী পাচারের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। বর্তমানে তারা পুলিশি রিমান্ডে রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করছেন ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

কর্মকর্তারা বলছেন, হূদয়ের অন্তত ৫০০ আইডি চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তার সঙ্গে হ্যাংকআউট বা পুলপার্টিতে যোগ দেওয়াদের বিশেষভাবে খোঁজা হচ্ছে।

তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, হ্যাংকআউটে যারা যোগ দিয়েছিল এরকম ৫০০ আইডি চিহ্নিত করে আমরা গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করছি। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই এ অভিযান চলছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, টিকটকের আড়ালে নারী পাচারকারী চক্রের সন্ধানে নেমে বেরিয়ে আসে পুলপার্টি নামে রাজধানীর আশপাশের রিসোর্টগুলোর অবৈধ কার্যক্রম। এসব অনুসন্ধানে ভয়াবহ তথ্য পাচ্ছে পুলিশ। পুলপার্টির নামে রিসোর্টগুলোতে চলছে অশ্লীলতা। ডিজে কিংবা পুলপার্টি নামে এখানে চলে উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা। উচ্চ শব্দে মিউজিকের তালে নাচানাচি।

চাকরি বা বড় তারকা হওয়ার প্রলোভনেও অনেকে যায় সেখানে। এখানে কেউ কারো পরিচিত নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্রি হয় পুলপার্টির টিকিট। উঠতি বয়সি তরুণদের আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করা হয় তরুণীদের। টাকার অঙ্কের সঙ্গে থাকে আয়োজনের ভিন্নতা। চাহিদামতো রুম সরবরাহসহ সব ধরনের ভোগ-বিলাসিতা থাকে পুলপার্টিতে।

সুইমিংপুলে উচ্ছৃঙ্খল নাচানাচির মধ্যেই নারীর সান্নিধ্যে আসে তরুণরা। অবৈধ সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বখাটেরা। সম্প্রতি আলোচনায় আসে টিকটক হূদয়। পুলপার্টির আড়ালে নারী পাচারের সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতায় পরিণত হয় সে।

হূদয়ের পুলপার্টি কিংবা হ্যাংকআউটে অংশ নেওয়া তাদের অনেকের কাছেই ছিল স্বপ্নের মতো। হ্যাংকআউট ও পুলপার্টিই ছিল টিকটক হূদয়ের নারীদের ফাঁদে ফেলার মূল অস্ত্র। পার্টিতে অংশ নেওয়া তরুণীদের মধ্যে থেকেই টার্গেট করা হতো। বেশি বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করত ভারতে।

বন্ধুত্বের কৌশলে তরুণীদের পাচার করে দিত হূদয়। পালিয়ে আসা এক ভুক্তভোগী জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা।

তিনি জানান, পুলপার্টিতে মাদক সেবন হয় অতিমাত্রায়। ওখানে টিকটক ছাড়াও আরো অনেক কিছু হয়।

তিনি বলেন, প্রথমে জানানো হয়, বানানো হবে টিকটক সুপারস্টার। এরপর লোভ দেখানো হয় ভালো চাকরির। এভাবে লোভের খপ্পরে পড়ে পাচার হয়ে যায় কিশোরীরা।

এদিকে নারী পাচারকারী চক্রের হোতা হূদয় ও তার কয়েক সহযোগীকে ধরার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টিকটকের আড়ালে নারী পাচারের পুরো নেটওয়ার্কটির সন্ধানে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হূদয় বাবুর সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৫০০ টিকটক গ্রুপ, আইডি, হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ ও ফেসবুক আইডি শনাক্ত করেছে পুলিশ। সবই রয়েছে নজরদারিতে।

ডিএমপি তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, বিদেশে পাচার করার পর যেসব মেয়ে ওখানে গেছেন, তাদের প্রথমেই নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে বিবস্ত্র করে বিভিন্নভাবে চিত্র ধারণ করে জিম্মি করা হতো। তাদের বিভিন্ন হোটেলেও যেতে বাধ্য করা হতো।

তিনি আরো বলেন, এরকম গ্রুপ খুলে হূদয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছেলেমেয়েকে সংযুক্ত করেছে। এই গ্রুপ এবং সংশ্লিষ্ট আরো অনেককে আমরা শনাক্ত করেছি।

হাতিরঝিলে টার্গেট করত হূদয় : ২০১৯ সালের মার্চের কোনো একসময় হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে ঘুরতে গিয়ে টিকটকার রিয়াদুল ইসলাম হূদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় বিক্রয়কর্মী এক তরুণীর। এই ঘটনার মাসখানেক পর বসুন্ধরা সিটিতে একটি দোকানে বিক্রয়কর্মীর পদে চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে গেলে সেখানে হূদয়ের সঙ্গে ওই তরুণীর আবার দেখা হয়। সেদিন একে অপরের মোবাইল ফোন নম্বর লেনদেন হয়। এরপর শুরু হয় ফোনালাপ।

গত বছর এই তরুণী মৌচাকের একটি বুটিক হাউসে বিক্রয়কর্মীর চাকরি নেয়। খোঁজ পেয়ে হূদয় সেখানে প্রায়ই দেখা করতে যেত। তরুণীকে ভালো চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেয় হূদয়। নিজেকে টিকটক তারকা বলে। কিছুদিন পর হূদয় তরুণীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এরপর ফেসবুকে যুক্ত দুজন। চলতে থাকে কথাবার্তা। একসময় প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যায়।

হ্যাংকআউটে টার্গেট তরুণী : ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ল্যান্ডপার্কে টিকটক হ্যাংকআউট প্রোগ্রাম আয়োজন করে একটি গ্রুপ। হূদয় ওই তরুণীকে সেখানে নিতে চায়। সবাই যাবে বলে তরুণীও রাজি হয়। ল্যান্ডপার্কের ওই পার্টিতে যায়। পার্টিতে ৭০/৮০ জন তরুণ-তরুণী অংশ নেয়। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পার্টি চলে। হূদয় তরুণীকে জানায় টিকটক করে টাকা আয় করার সুযোগ আছে। হূদয় তাকে সব শেখাবে বলেও জানায়।

এরপর থেকেই হূদয় ওই তরুণীকে বুটিক শপের চাকরি ছাড়তে চাপ দিতে থাকে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হলে, তরুণী বেকার হয়ে পড়ে। তখনো হূদয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ওই বছরে ১৮ সেপ্টেম্বর হূদয় ফের গাজীপুরে আফরিন রিসোর্টে টিকটকারদের একটি পুলপার্টিতে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।

ওই পার্টিতে সারা দেশ থেকে ৭০০/৮০০ টিকটকার অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে মেয়ে ছিল দুই শতাধিক। ছেলেরা কেউ কেউ পার্টিতে টাকা দিলেও মেয়েদের কাছ থেকে পার্টি বাবদ কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। হূদয়ের কোনো এক ‘বড়ভাই’ সব খরচ বহন করেছে বলেও আলোচনা হয়। পার্টিতে হূদয়ের সহযোগী মারুফ, ইমাম, সম্রাট, আবিদ, সাইফুল ও ইমন ছিল। আর এখান থেকেই তরুণীদের টার্গেট করে বিভিন্ন সীমান্ত ঘোরানোর নাম করে ভারতে পাচার করা হতো।

অশ্লীল ও অশালীন টিকটক-লাইকি মিউজিক ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ায় রাজশাহীতে সহযোগীসহ দুই তরুণীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রোববার সন্ধ্যায় রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।

এরা হলেন টিকটক-লাইকি তারকা হিসেবে পরিচিত তানিশা ও পায়েল।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিকী জানান, টিকটক-লাইকি গ্রুপের হয়ে পায়েল ও তানিশা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মিউজিক ভিডিও করার জন্য তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করে। তাদের ফাঁদে পড়া একজন ভিকটিমকেও উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার পায়েল ও তানিশার কাছ থেকে টিকটক-লাইকি গ্রুপের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এ গ্রুপে জড়িত অনেকের নামও পাওয়া গেছে। তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

 

Wordbridge School
Link copied!