ঢাকা : রাজধানী ঢাকায় ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের বিনোদনের জন্য ১০২টি বার আছে, যার অর্ধেকই অবৈধ।
এছাড়া তাদের জুয়া খেলার জন্য আছে নামিদামি বেশ কয়েকটি ক্লাব। এসব বার ও ক্লাবে অসামাজিক কার্যকলাপের ঘটনা ওপেন-সিক্রেট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ অসৎ শ্রেণির সদস্যদের ম্যানেজ করেই এ ধরনের কার্যকলাপ চলছে। নেই প্রশাসনের কোনো নজরদারি।
রাজধানীর অদূরে অভিজাত বোট ক্লাবে নায়িকা পরিমনিকে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার ঘটনায় ওই ক্লাবকে ঘিরেও অসামাজিকতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ঘটনায় পুলিশ ওই ক্লাবের সদস্য নাসির ইউ মাহমুদসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে বনানীতে দি রেইন ট্রি আবাসিক হোটেলেও অবৈধ বার তৈরি করে অসামাজিক কার্যকলাপের ঘটনা ফাঁস হলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর হোটেলের বার, ক্লাবগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।
জানা যায়, তুরাগ নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা বোট ক্লাব। ২০২০ সালের শুরুর দিকে নান্দনিক স্থাপনা ঢাকা বোট ক্লাবের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। মদপান ও ফুর্তি করার জন্য বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে বোট ক্লাবে।
এছাড়া এ ক্লাবে সদস্য ছাড়াও মদ কিনতে পারেন বহিরাগতরাও। ঢাকা বোট ক্লাবটি তিনতলা একটি স্থাপনা। নিচ তলায় রয়েছে বসার জায়গা আর দ্বিতীয় তলায় রয়েছে মদের বার। আর তৃতীয় তলায় রয়েছে স্বল্পসময়ের জন্য রুম ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা। যেখানে অবৈধ কার্যকলাপ চলার অভিযোগ সাধারণ মহলে দীর্ঘদিনের।
বিরুলিয়া গ্রামের এক প্রভাবশালী নেতা জানান, ঢাকা বোট ক্লাবে বৈধ মদের বার থাকা ও অন্যান্য সুবিধা থাকায় ঢাকা শহরের ধনাঢ্য পরিবারের অনেকেই এখানে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। ক্লাবের সদস্য ছাড়াও যে কেউ ওখানে বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ কেনার সুযোগ পান। ক্লাবের দায়িত্বে থাকা অফিসারদের সঙ্গে সখ্যতা করে রাত্রি যাপনেরও সুযোগ পান কেউ কেউ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ক্লাবটিতে বৈধ-অবৈধ সকল কিছুই করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। কারণ, ঢাকা বোট ক্লাবের চেয়ারম্যান হচ্ছে পুলিশের আইজিপি বেনজির আহম্মেদ।
সরেজমিনে সোমবার (১৪ জুন) ঢাকা বোট ক্লাব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো সেখানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তবে পরীমনির ধর্ষণচেষ্টা ঘটনার পর বহিরাগতদের প্রবেশে কড়াকড়ি করা হয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, ক্লাবের সদস্যই সাধারণত এখানে আসেন। তাদের সঙ্গে কোনো অতিথি আসলে তারাই কেবল এখানে প্রবেশ করতে পারে। তিনি আরো জানান, এখানে প্রতিদিনই গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে ১০২টি বার রয়েছে, যার মধ্যে ৫২টি বার সরকারের অনুমোদিত। এর পাশাপাশি অলিখিতভাবে অনুমোদন ছাড়াই আরো অন্তত ৫০টি বার তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এক সময় রাজধানীতে পুলিশের অবৈধ আয়ের বড় উৎস ছিল মাদক স্পট। কিন্তু বিগত ৫ বছরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মাদক স্পটের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কারণে স্পটগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে গেছে। ওইসব স্পটে স্থানীয় থানা-পুলিশের সঙ্গে উঠতি রাজনৈতিক নেতারা চাঁদাবাজি করেন। এ কারণে পুলিশের অবৈধ আয়ের দৃষ্টি এখন বারগুলোর দিকে।
একেকটি বার থেকে স্থানীয় থানা-পুলিশ মাসোহারা পায়। রাজধানীর ফাইভ স্টার ও ফোর স্টার হোটেলগুলোতে সরকার অনুমোদিত বারগুলোতে তেমন
চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ নেই। হোটেলগুলোর বাইরে পৃথকভাবে গড়ে উঠা বারগুলোতে চাঁদাবাজি হয়। এরমধ্যে পরীবাগে ২টি, বাংলামোটরে ২টি, মগবাজারে ১টি, কাকরাইলে ৩টি, গুলশানে ৩টি ও তেজগাঁও এলাকায় ১টি বারে সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিতে হয়।
রাজধানীর একাধিক বারের মালিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘সবই তো বুঝেন, চাঁদা না দিলে তো ব্যবসা করতে দেবে না। তার ওপর আছে বিভিন্ন প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের চাঁদার হুমকি। ফ্রি খাওয়াতেও হয় অনেককে। এ কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থানীয় থানা-পুলিশকে বেশি ম্যানেজ করতে হয়। বৈধ ব্যবসা চালাতে গেলেই যেখানে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা চালানো যায় না সেখান বার ও ক্লাবে মদের ব্যবসার জন্য চাঁদা গুনতেই হবে’।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর অভিজাত এলাকার বার ও ক্লাবগুলোতে প্রতিদিনই কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও পিছিয়ে নেই।
সংশ্লিষ্ট এলাকার ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী মাস্তানরা এসব ক্লাব ও বার থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি বার ও ক্লাবগুলোতে মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবহার প্রতিরোধে নিয়োজিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এসব বার ও ক্লাবে অভিজাত পরিবারের ধনীর দুলাল-দুলারীই বিনোদনের জন্য গিয়ে থাকেন।
এর আগে রাজধানীর বনানীর দি রেইন ট্রি হোটেলে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদের মদ্যপান, অসামাজিক কার্যকলাপের ঘটনা ঘটে। এর আগে ২১০৭ সালের ১৮ এপ্রিল কচুক্ষেতের নিউ ওয়েভ ক্লাবে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনসহ ১১ সদস্য মিলিটারি পুলিশের হাতে আটক হয়।
ডিবির পূর্ব বিভাগের অস্ত্র উদ্ধারকারী টিমের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ১১ সদস্য তাদের অভিযানের আচরণবিধিও লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগের তদন্ত হয়। নিউ ওয়েভ ক্লাব ডিবির পশ্চিম বিভাগের মধ্যে পড়লেও পূর্ব বিভাগের অস্ত্র উদ্ধারকারী টিম অভিযান চালানোর সময় ডিবির কোনো উচ্চপদের কর্মকর্তার অনুমতিও নেয়নি।
ওই বছরেরই ২৩ এপ্রিল পরীবাগে পর্যটন করপোরেশন পরিচালিত সাকুরা বারে চাঁদাবাজির অভিযোগে যুবদল নেতা জনি ওরফে বাবা জনিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে বারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ঢাকা বোট ক্লাবের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর অন্যান্য ক্লাব ও বারের ওপর নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের বাইরে ক্লাব ও বারগুলো বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুনুর রশিদ বলেন, অনুমোদিত ক্লাব ও বারগুলোতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনুমোদনের বাইরে ক্লাব বার থাকলে তার বিরুদ্ধে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি আরো বলেন, এ ধরনের অপকর্ম করে কেউ পার পাবে না। আমরা সেই ব্যবস্থা নিয়েছি।
এর আগে বোট ক্লাবে নায়িকা পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয় গত সোমবার। মামলার পরপরই প্রধান আসামি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :