ঢাকা : কক্সবাজার সীমান্তে যেন ইয়াবার স্রোত বইছে। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি প্রায় প্রতিদিন লাখ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করলেও এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। জব্দের বাইরেও বড় বড় চালান সীমান্ত গলিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকছে। আর এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।
রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজারে বিজিবির সঙ্গে গুলিবিনিময়ে শীর্ষ দুই ইয়াবা কারবারি নিহত হন। এ সময় উদ্ধার হয় প্রায় ৪ লাখ পিস ইয়াবা।
জানা যায়, নানা কৌশলে সীমান্ত থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সব প্রান্তে। আর এখন কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প হয়ে উঠছে মাদক কারবারিদের ‘সেফ জোন’। সমুদ্রপথে বড় বড় চালান আনার পর তা প্রথমে ক্যাম্পের নিরাপদ জায়গায় নেওয়া হয়।
চলমান পরিস্থিতিতে নতুন কৌশলে মাদকবিরোধী অভিযান কীভাবে আরো জোরালোভাবে শুরু করা যায়, এনিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আর মাদক কারবারে অনলাইনকেন্দ্রিক প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
মাদকবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কক্সবাজারসহ দেশের একাধিক জেলার মাঠ পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানান, দেশে ইয়াবার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ইয়াবার মার্কেট সবচেয়ে বড়। মিয়ানমার থেকে আসে ছোট্ট ইয়াবার বড়ি। এক সময় নাফ নদ দিয়ে বেশি চালান এলেও এখন বদলেছে রুট। এখন সমুদ্রপথ ও পাবর্ত্য এলাকা হয়ে অধিকাংশ চালান ঢুকছে।
মাদকবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, তিনটি বিষয় দমন করতে না পারলে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
এগুলো হলো, এক. মাদক কারবারের অর্থনৈতিক চেইন বন্ধ করা, দুই. এখাতে অর্থ বিনিয়োগকারী ও রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনা এবং তিন. টেকনাফ বন্দর হয়ে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে মাদকের অর্থ লেনদেন বন্ধ করা।
তিনি জানান, মূলত টেকনাফ থেকে বার্মিজ কাপড়, আচার, কাঠ ও পেঁয়াজ আসে। এর সঙ্গে মাদকও আনা হয়। তার মত হলো, ইয়াবার স্রোত বন্ধ করতে হলে প্রয়োজনে মিয়ানমারের বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে। মিয়ানমার থেকে স্থায়ীভাবে গরু আমদানিও বন্ধ করা দরকার। কারণ এসব গরু বিক্রির অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে মাদক কারবারে ব্যবহার হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে দেশে ইয়াবা জব্দ হয় দুই কোটি ৫৯ লাখ ৮৯ হাজার ৪২টি, ২০১৮ সালে তিন কোটি ৬৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮২২টি, ২০১৯ সালে দুই কোটি ৪৯ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩টি, ২০২০ সালে তিন কোটি ১০ হাজার ৩৪৮টি এবং চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দুই কোটি ৬১ লাখ ১১ হাজার ১৭৬টি।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক মোকাবিলায় কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এক ধরনের বড় চ্যালেঞ্জ।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচশ রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে নতুন-পুরোনো রোহিঙ্গা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকায় রয়েছে ১৩ নম্বর ক্যাম্পের সি-২ ব্লকের আবদুল গফুর ওরফে আব্দুল্লাহ, একই ক্যাম্পের সি-৩ ব্লকের আবুল বাশার, ট্যাংখালি ক্যাম্পের হাফিজুর রহমান ও শামসুল আলম।
এছাড়া পুরোনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দারা। তাদের অধিকাংশ এখন ক্যাম্প ছেড়ে টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় বাঙালি পরিচয়ে বসবাস করছেন।
রোহিঙ্গাদের মাদক কারবার সম্পর্কে কক্সবাজার এলাকার আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, গত বছর মাদক কারবারে জড়িত থাকায় কক্সবাজার এলাকা থেকে ২২১ বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। আর সে সময় কক্সবাজারে মাদক কারবারি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় ১০৫ রোহিঙ্গা।
সংশ্নিষ্ট এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, মাদক কারবারে এক যুগের বেশি সময় ধরে কোটি কোটি টাকা অর্থলগ্নি করছেন এমন এক রাঘববোয়ালের নাম সমপ্রতি বেরিয়ে এসেছে। তার নাম মো. মুস্তাক। তিনি মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। বর্তমানে বসবাস করছেন সৌদি আরবে। মুস্তাক বাংলাদেশি একটি চক্রের সঙ্গে মিলেমিশে মাদক কেনাবেচায় অর্থলগ্নি করে আসছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকার সৌদি প্রবাসীদের তালিকা বাংলাদেশি এজেন্টের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন মুস্তাক। এরপর প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠাতে চাইলে ইয়াবা কেনাবেচার টাকা থেকে তা দেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের পরিশোধ করে মুস্তাকের এজেন্টরা। এর বিনিময়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নেন মুস্তাক। পরে প্রবাসী আয় অবৈধ চ্যানেলে মাদক কারবারে ঢুকে যাচ্ছে। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত মো. শরীফ সহায়তা করেছেন মুস্তাককে। তিনিও এক সময় সৌদি আরবে ছিলেন। মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে শরীফ বর্তমানে কারাগারে থাকলেও মুস্তাকের কারবার বন্ধ হয়নি।
আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক নির্মূল না করার পেছনে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের একগুঁয়েমি ও খামখেয়ালি দায়ী। মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে ইয়াবার বড় বড় কারখানা থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় কুযুক্তি দিয়ে মাদকের ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্বের বিষয়টি এড়ানোর অপচেষ্টা করে আসছে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় যুক্তি দেয়-ইয়াবা তৈরির মূল কাঁচামাল সিউডোফেড্রিন প্রতিবেশী দেশ থেকে তাদের সেখানে যায়। তবে ইয়াবা তৈরির এই কাঁচামাল ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এককেজি সিউডোফেড্রিনের বাজারমূল্য প্রায় ৫০ ডলার।
ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, স্কুপ, আইস নিয়মিতই ধরা পড়ছে। ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে কারবার করায় অনেক সময় সবাইকে ধরা সম্ভব হয় না। তবে কারো ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য পেলে অভিযান চালানো হয়।
পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন ভেঙে দেওয়া, মাদকসেবীদের সুপথে আনতে চিকিৎসাসহ সার্বিক প্রক্রিয়ায় পরিবার ও সমাজের বড় ভূমিকা রয়েছে।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, মাদক মোকাবিলায় সবার আগে এর সঙ্গে জড়িতদের অর্থনৈতিক চেইন ভেঙে দিতে হবে। এটা না পারলে অভিযান চালিয়েও মাদক নির্মূল করা কষ্টসাধ্য হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি অভিযানও জোরালো করতে হবে।
এদিকে গতকাল রোববার কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে দুই মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। পৃথক এ ঘটনায় ৩ লাখ ৯০ হাজার পিস ইয়াবা ও দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
বিজিবি জানায়, চলতি জানুয়ারি থেকে রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও পুলিশ, র্যাব ও কোস্টগার্ড প্রায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ইয়াবা জব্দ করে যাচ্ছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :