ঢাকা : ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন আছাদুজ্জামান মিয়া। পরে পুরস্কার হিসেবে তাকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
এই কয়েক বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, বদলি ও নিয়োগসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান মিয়াভাই খ্যাত সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
পুলিশের চাকরিতে জনগণের রক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তিনি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। গাড়ি, বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট কী নেই ডিএমপির সাবেক এই কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার।
গত ১২ সেপ্টেম্বর তিনি পালাতে চেয়েছিলেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি মিয়া ভাই’র। ওই রাতেই মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর কালো রঙের ক্লুগার ব্র্যান্ডের প্রাইভেট কার থেকে তাকে আটক করে র্যাব। এ সময় গাড়িতে থাকা দুটি ব্রিফকেসের সন্ধান মিলে। ব্রিফকেস দুটি জব্দ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নেয়া হয়। শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ব্রিফকেস দুটি খোলা হয়।
ব্রিফকস ভর্তি লকারের চাবি, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, হিসাব বিবরণী ও এফডিআর নথি দেখে হতভম্ব হয়ে যান খোদ তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
অভিযানে থাকা র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব গোয়েন্দারা জানতে পারে আছাদুজ্জামান মিয়া প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যাচ্ছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে তার ব্যবহৃত দামি গাড়ি জব্দসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। গাড়ির ভেতর থেকে দুটি ব্রিফকেস জব্দ করা হয়। সেগুলোর সিজার লিস্ট করে ডিবির কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, তার ব্রিফকেসে ভর্তি ছিল লকারের চাবিসহ বিভিন্ন ব্যাংকের কাজপত্র ও দলিলপত্র। পরের দিন ডিবি পুলিশ আছাদুজ্জামান মিয়াকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার অবৈধ উপার্জনের অর্থ-সম্পদ বেশির ভাগই আত্মীয়-স্বজনদের নামে করেছেন।
ডিবির একটি সূত্র জানায়, সদ্য অবসরে যাওয়া সিআইডির ডিআইজি ইমাম হোসেনের মাধ্যমেই লকারগুলো বানানো হয়। লকারের সন্ধানও তিনি জানতেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে অর্থ পাচার ও সম্পদের বিবরণী দিতে পারলেও লকারের সন্ধান তিনি দেননি। সেগুলো ডিআইজি ইমাম হোসেন ভালো বলতে পারবেন বলে স্বীকার করেন আছাদুজ্জামান মিয়া।
ডিবির একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমানে ইমাম হোসেন আত্মগোপনে আছেন। তাকে খুঁজতে এরই মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। ডিবি পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, ওই লকারের ভেতরে নগদ অর্থ ও ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা রয়েছে।
ডিএমপির একাধিক সূত্র জানায়, আছাদুজ্জামান মিয়া ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে ডিএমপির লজিস্টিক শাখার ডিসি ছিলেন ইমাম হোসেন। ওই সময় কেনাকাটায় যেসব দুর্নীতি হয়েছে তার বেশির ভাগ অংশ বিদেশে পাচার, সম্পদ ক্রয় করেন। অবশিষ্ট টাকা ডলার ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রা করে রাখার জন্য ডিআইজি ইমাম হোসেন লকার বানিয়ে দেন। এমন অনেক লকার রয়েছে যা আছাদুজ্জামান নিজেই জানেন না লকারগুলো কোথায় আছে।
ডিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এফডিআরের নথিতে সাউথইস্ট ব্যাংকের ২৫টি এফডিআর, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ছয়টি এফডিআর, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের দুটি এবং পূবালী ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকের একটি করে এফডিআর রয়েছে। এসব এফডিআর বিভিন্ন জনের নামে করা হয়েছে। যাদের নামে এফডিআর করা হয়েছে তাদের কেউই সাবেক কমিশনারের আত্মীয়স্বজন নয়। সাউথইস্ট ব্যাংকে সুরমা এন্টারপ্রাইজের নামে পাঁচটি এফডিআর করা হয়েছে।
এ ছাড়া মেহেদি হাসান, রাসেল, আকাশ আহমেদ, আনোয়ারুল হক, দেলোয়ারা তাহেরা হ্যাপি, শারমিন জাহান, রাসেদুল হকসহ ১০ জনের নামে এফডিআর করা হয়েছে। একেকটি এফডিআরের অর্থের পরিমাণ গড়ে ১০ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
এ ছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংক রামপুরা শাখায় এস এম নিয়াজন উদ্দিনের নামে ছয়টি এফডিআর করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় গত ৫ আগস্ট উত্তরায় এক পোশাককর্মীকে হত্যা মামলা হয়েছে।
এ দিকে ব্যক্তিজীবনে তিন ছেলে-মেয়ের বাবা আছাদুজ্জামান মিয়ার নারী কেলেঙ্কারির ঘটনাও তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। একাধিক নারী পুলিশ সদস্যের সঙ্গে তার রগরগে বিকৃত আলাপে ছি ছি রব পড়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সাবেক এই ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে।
অপর দিকে আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে, শ্যালক ও মেয়ের জামাইয়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারি-বেসরকারি ৩০টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দুদক। গত ৯ সেপ্টেম্বর তার ব্যাংক হিসাব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
গত ১৮ আগস্ট কমিশন সভায় আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরে ২৮ আগস্ট কমিশনের উপ-পরিচালক মো: হুমায়ুন কবীরকে প্রধান করে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির আরেক সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো: আলিয়াজ হোসেন।
দুদক সূত্র জানায়, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রীর নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাট এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ৬৭ শতক জমি রয়েছে। এই তিন জেলায় তার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আরও ১৬৬ শতক জমি।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠা জমির ওপর ছয়তলা একটি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুরের কালীগঞ্জের চাঁদখোলা মৌজায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সর্বমোট ১০৬ শতক জমি কেনা হয় আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে।
এ ছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় আফরোজার নামে ২৮ শতক জমি কেনা হয়। একই বছর একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনা এবং পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে ১০ কাঠা জমি রয়েছে।
এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর আফতাবনগরে ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডে ২৬ নং প্লটে ২১ কাঠা জমি এবং নিকুঞ্জ-১-এ ছোট ছেলের নামে একটি বাড়ি রয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে তথ্য এসেছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা আছাদুজ্জামানের নিকুঞ্জের বিলাসবহুল বাড়িতে ভাঙচুর-হামলাও চালায়।
এ ছাড়া ফরিদপুরে মিয়া ভাইয়ের দখল থেকে নিজেদের বিপুল জমি উদ্ধার করেছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। সূত্র : নয়া দিগন্ত
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :