ঢাকা : এতদিন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েতসহ অন্য সব দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স বেশি আসছিল। এবার ওইসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স কমলেও বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৬৯ কোটি ২২ লাখ (১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি।
স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে যে দেশ থেকে, সেই সৌদি আরব থেকে এই ছয় মাসে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে ২১ শতাংশের মতো। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ২৪৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন সে দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা।
এই ছয় মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স কমেছে সবচেয়ে বেশি ৪১ শতাংশ। যুক্তরাজ্য থেকে কমেছে ১৫ শতাংশের বেশি। কাতার থেকে কমেছে ১০ শতাংশের মতো। মালয়েশিয়া থেকে কমেছে ৫৫ শতাংশ।
করোনা মহামারির ধাক্কা সামলাতে আমেরিকা বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রণোদনা ঘোষণা করায় দেশটির অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে সে দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা বেশি অর্থ দেশে পাঠানোয় রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা।
মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরের (২০২০-২১) পুরোটা সময় (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ করা যায়। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে দেশে।
তবে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সপ্রবাহে ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রায় প্রতি মাসে কমছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। অক্টোবরে এসেছে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে আসে আরো কম, ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। সর্বশেষ ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়ে ১৬৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১ হাজার ২৩ কোটি ৭৯ লাখ (১০.২৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২১ শতাংশ কম।
দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা সোয়া কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। নতুন বছরের শুরু থেকে তা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর দেশে যে রেমিট্যান্স আসে, তার প্রায় অর্ধেক পাঠান সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিরা।
স্বাধীনতার পর থেকেই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান সৌদি আরবে থাকা বাংলাদেশিরা। এত দিন দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এদিকে ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে আমিরাতকে ডিঙিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্র। সেই ইতিবাচক ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা যেখানে ১৬৯ কোটি ২১ লাখ ডলার পাঠান, সেখানে আমিরাত প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন অর্ধেকেরও কম ৮১ কোটি ৫২ লাখ ডলার। বরাবরের মতো এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ২৪৩ কোটি ৩৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে সৌদি আরব থেকে।
এই ছয় মাসে অন্য দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ৮৮ কোটি ডলার। কুয়েত থেকে এসেছে ৮৪ কোটি ডলার। কাতার থেকে এসেছে ৬৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। ইতালি থেকে এসেছে ৫০ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। মালয়েশিয়া, ওমান ও সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে যথাক্রমে ৫২ কোটি ১৫ লাখ, ৪৮ কোটি ৫ লাখ এবং ২০ কোটি ডলার।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল সৌদি আরব থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল ৩৪৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২৪৪ কোটি ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২০২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এ ছাড়া কুয়েত থেকে ১৮৮ কোটি ৬৫ লাখ ডলার, কাতার থেকে ১৪৫ কোটি ডলার, মালয়েশিয়া থেকে ২০০ কোটি ডলার এসেছিল। এ ছাড়া ওমান, ইতালি ও সিঙ্গাপুর থেকে যথাক্রমে ১৫৩ কোটি ৫৬ লাখ, ৮১ কোটি ৯ লাখ এবং ৬২ কোটি ৪৯ লাখ ডলার আসে।
এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠান। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৪০১ কোটি ৫১ লাখ ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৪৭ কোটি ২৫ লাখ ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৪০ কোটি ৩৪ লাখ ডলার পাঠান প্রবাসীরা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সৌদি প্রবাসীরা ৩১১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২৫৪ কোটি ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল ১৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
২০১২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসত কুয়েত থেকে। একক দেশ হিসেবে কুয়েত থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ এখন ষষ্ঠ অবস্থানে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়; কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা সব মিলিয়ে ১০ লাখের মতো হবে। এর মধ্যে নিউইয়র্কেই থাকেন প্রায় তিন লাখ। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস ও জ্যামাইকায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস।
ইউএসএ-বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক ক্লাবের চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান হাসান নিউইয়র্কেই থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন নির্মাণসহ আরো কিছু ব্যবসা রয়েছে তার। বাংলাদেশেও ব্যবসা রয়েছে হাসানের।
উত্তরাঞ্চলের রংপুরের তারাগঞ্জে তিনি গড়ে তুলেছেন ব্লিং লেদার প্রডাক্টস লিমিটেড নামের অত্যাধুনিক জুতা কারখানা।
অন্য দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাড়ছে কেন, এ প্রশ্নের জবাবে হাসানুজ্জামান বলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসীরা যে টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন, তার প্রায় পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে যাচ্ছে। সে কারণেই এখন বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর পেছনে আছে বাংলাদেশ সরকারের ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা। এখন যদি কেউ এখান থেকে ১০০ ডলার দেশে পাঠান, তাহলে এর সঙ্গে বাড়তি ২১৪ টাকা ৫০ পয়সা প্রণোদনা পান। সে কারণেই প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন।
হাসানুজ্জামান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ছে। নানা পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন তারা। অনেকের উপার্জনও ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকে টাকা রাখলে মুনাফা পাওয়া যায় না। তবে দেশে টাকা পাঠিয়ে প্রবাসী বন্ড কিনলে ১২ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা এবং বন্ড কিনে মুনাফার আশায় এখন ইউএসএ থেকে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা পেশাগতভাবে ‘তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে’ আছেন।
ফলে তাদের উপার্জনও হয় বেশি। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যারা দেশে টাকা পাঠান, তারা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন। তাদের অনেকেই আবার বন্ডে বিনিয়োগ করেন।
তিনি বলেন, মহামারির মধ্যে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছিল। যার কাছে যা জমানো টাকা ছিল, পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে সব দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। করোনায় সবকিছু বন্ধ থাকায় অবৈধ পথে (হুন্ডি) কোনো রেমিট্যান্স আসেনি; সব এসেছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে। সে কারণেই গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এরই মধ্যে দুটি সুসংবাদ এসেছে। তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্রমিক যাবে সেখানে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। সেখান থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসবে। আরেকটি সুখবর হচ্ছে, সরকার ১ জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমার বিশ্বাস জানুয়ারি থেকেই বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, আমেরিকা থেকে যে রেমিট্যান্স বাড়ছে, সেটা একটা ভালো খবর। এটা যদি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমে গেলেও সামগ্রিক রেমিট্যান্সপ্রবাহ যদি ইতিবাচক থাকে, তাহলে তা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো হবে।
প্রণোদনার পরিমাণ ২ থেকে আড়াই শতাংশ করায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বাড়বে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডিসেম্বরে কিন্তু সার্বিক রেমিট্যান্সপ্রবাহ খানিকটা বেড়েছে। সামনে দুই ঈদ উৎসব আছে। আমার মনে হয়, আগামী দিনগুলোতেও এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :