ঢাকা: দেশের বিমা খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি পুরোনো বিষয় হলেও ২০২২ সালের মতো কেলেঙ্কারি ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এক সময় দুর্নীতি-অনিয়মের আখড়া হিসেবে পরিচিত ছিল বিমা অধিদপ্তর। সরকার ২০১০ সালে বিমা খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। বিমা অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে বিমা খাতের নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সেইসঙ্গে করা হয় নতুন বিমা আইন।
বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর প্রথমদিকে সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেন। এতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে এই খাতে। হঠাৎ করেই পথ হারায় সংস্থাটি। আইডিআরএ’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি নানা বিতর্কে জড়ান একাধিক কর্মকর্তা। বিমা গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের দায়ে জেল খাটছেন একাধিক পরিচালক।
এর আগে ২০২০ সালে ড. এম মোশাররফ হোসেন আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান হওয়ার পর একের পর এক বিতর্কে জড়াতে থাকেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অযোগ্য ব্যক্তিকে বিমা কোম্পানির সিইও করা, কোম্পানির কাছে ঘুস দাবি করাসহ নানা অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে ২০২২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে আইডিআরএ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানের বিরুদ্ধে এ ধরনের দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ আগে কখনো ওঠেনি। স্বাভাবিকভাবেই বছরটি বিমা খাতের জন্য কলঙ্কিত হয়ে থাকবে।
ডেল্টা লাইফ থেকে মোশাররফের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার অভিযোগ তোলে। এ ধরনের অভিযোগ তোলার কয়েকদিনের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক বসান মোশাররফ হোসেন। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদ থেকে আদিবা রহমানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আদালতে ডেল্টা লাইফ নিয়ে একাধিক মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে আইডিআরএ থেকে বিদায় নিতে হয় মোশাররফকে।
দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের পদ থেকে মোশাররফের পদত্যাগের পাশাপাশি ২০২২ সালে বিমা খাতে সব থেকে আলোচিত বিষয় ছিল ফারইস্ট ইসলামী লাইফের প্রতিষ্ঠাতা এম এ খালেক এবং সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের জেলে যাওয়া। ফারইস্ট লাইফে লুটপাট চালিয়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে চলতি বছর গ্রেফতার হন খালেক ও নজরুল। বর্তমানে এ দুজন কারাগারে। বিমা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও সাবেক চেয়ম্যানের এর আগে জেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের গ্রাহকদের অর্থ লোপাটের দায়ে খালেক ও নজরুল জেলে যাওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই হোমল্যাল্ড লাইফে ঘটে আরেক কেলেঙ্কারির ঘটনা। গ্রাহকের বিমা দাবির অর্থ না দেওয়ার মামলায় ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের লন্ডন প্রবাসী সাত পরিচালককে কোম্পানির প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে মতিঝিল থানা। সাত পরিচালকের মধ্যে রয়েছেন হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, পরিচালক আবদুর রব, পরিচালক কামাল মিয়া, পরিচালক আবদুর রাজ্জাক, পরিচালক আবদুল আহাদ, পরিচালক জামাল উদ্দিন ও পরিচালক আবদুল হাই। তাদের কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
বিমা দাবির টাকা না পেয়ে মাগুরার চার গ্রাহকের দায়ের করা মামলায় এ সাত পরিচালককে গ্রেফতার করা হয়। গত ২৬ সেপ্টেম্বর তাদের জামিন আবেদন করা হলেও তা নাকচ করেন আদালত। সেইসঙ্গে ২৯ সেপ্টেম্বর মাগুরার আদালতে আসামিদের হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর এ সাত পরিচালক মাগুরা থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন লাভ করেন।
২০২২ সালে বিমা খাতে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল একটি গ্রুপের ডেল্টা লাইফ দখলের চেষ্টাও। শেয়ারবাজারের আলোচিত বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরুর নেতৃত্বে চলে এ প্রচেষ্টা। আর আবুল খায়ের হিরুকে সহায়তা করার চেষ্টা করেন দুর্নীতির অভিযোগে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করা মোশাররফ। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হিরু নিজের এবং তার স্ত্রী, বাবা ও বোনের বিও হিসাব ব্যবহার করে ডেল্টা লাইফের মোটা অঙ্কের শেয়ার কেনেন। কিন্তু মোশাররফ পতদ্যাগ করলে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে হিরু ডেল্টা লাইফের পরিচালক হওয়ার চেষ্টা করেন। সেই প্রচেষ্টাও সফল হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ডেল্টা লাইফ থেকে প্রশাসক তুলে নেয় আইডিআরএ। সেইসঙ্গে কোম্পানিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন পর্ষদকে। এতে ফের ডেল্টা লাইফের কর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছেন কোম্পানিটির সাবেক পরিচালকরা।
এদিকে বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের দাবির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করে না। উল্টো বিভিন্নভাবে গ্রাহকদের হয়রানি করে- এ অভিযোগ পুরোনো হলেও এখনো এ অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। আগের মতোই এখনো বিভিন্ন বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে নানা টালবাহানা করছে। প্রতিটি বিমা কোম্পানিতেই গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা বকেয়া রয়েছে।
এর মধ্যে গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা না দেওয়ার তালিকায় ২০২২ সালে যেসব জীবন বিমা কোম্পানি সব থেকে বেশি আলোচিত এর মধ্যে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বায়রা লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ। এ কোম্পানিগুলোতে বিপুল গ্রাহকের বিমা দাবির টাকা বকেয়া রয়েছে।
গ্রাহকদের দাবির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ না করায় বিমা কোম্পানিতে গ্রাহকের সংখ্যাও কমেছে। বছর পাঁচেক আগে যেখানে দেশে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর চলমান বিমা পলিসির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮ লাখ ৬০ হাজার। ২০২২ সালে তা কমে ৭৩ লাখ ৮৩ হাজারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর পলিসি সংখ্যা কমে অর্ধেকে চলে এসেছে। অথচ এসময়ের মধ্যে একদিকে দেশে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে বড় হয়েছে দেশের অর্থনীতি।
বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি এবং দেশি-বিদেশি মালিকানায় ৩৫টি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবসা করছে। পাঁচ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ৩১টি। জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে গ্রাহক সংখ্যা একদিনে কমেনি। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
২০১৯ সালে দেশে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর সচল পলিসি ছিল ৯৭ লাখ ৪০ হাজার। পরের বছর ২০২০ সালে তা কমে ৮৫ লাখ ৬০ হাজারে নেমে যায়। ২০২১ সালে আরও কমে ৮২ লাখ ৮০ হাজারে দাঁড়ায়।
সোনালীনিউজ/এএইচ/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :