ঢাকা : জীবন বীমা কোম্পানি মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের চলতি দায়িত্ব পালন করা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের দুইরকম শিক্ষাসনদ পাওয়া গেছে। একটি শিক্ষাসনদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যটি বিতর্কিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার।
সোনালী নিউজের হাতে আসা তার দুটি সনদ নিয়েই ‘সন্দেহ’ প্রকাশ করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এমনকি বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষই (আইডিআরএ) তার শিক্ষাসনদে ‘আস্থা’ রাখতে পারছে না। এ জন্য সাবেক কর্মস্থলগুলোতে সনদ যাচাইয়ের কার্যক্রম শুরু করেছে।
মার্কেন্টাইল ইসলামি লাইফের সিইও'র দুইরকম শিক্ষাসনদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়ের অধীনে তৎকালীন সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৯৪-৯৫ সেশনে রসায়ন বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তিনি স্নাতক শেষ করেন। পরীক্ষা দেন ১৯৯৭ সালে। এই সনদটি ইস্যু করা হয় ২০০০ সালের ৪ জানুয়ারি। সনদ অনুযায়ী তার রোল নম্বর ১৫৭৬৫।
মুহাম্মদ সাইদুল আমিন স্নাতকোত্তরও করেছেন স্নাতকের সেশন অর্থাৎ ১৯৯৪-৯৫ সেশনে! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে রসায়ন বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন তিনি। তবে তার এই সনদটি কবে ইস্যু করা হয়েছে তা নিশ্চত হওয়া যায়নি। কারণ প্রাপ্ত সনদটিতে বেশ কিছু জায়গায় ঘষামাজা করা হয়েছে। এই সনদে তার রোল নম্বর ৩৭৪৮৬। পরীক্ষা দিয়েছেন ১৯৯৮ সালে। আর পাসের সন দেখানো হয়েছে ২০০১।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই সেশনে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাশ করার কোনো সুযোগ নেই। অবধারিতভাবেই দুটি সনদই ভুয়া।
সনদ দুটির সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, একজন শিক্ষার্থী একই সেশনে অনার্স এবং মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারেন না। তাই সহজেই অনুমেয় এই সনদ সঠিক নয়।
তাহলে সনদ কীভাবে পেল জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, একটা সময় নীলক্ষেতসেহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় টাকার বিনিময়ে ভুয়া সনদ সহজেই পাওয়া যেত। এটাও সেই প্রক্রিয়ায় হয়তো পেয়েছে।
এই সনদের বিষয়ে মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি সোনালী নিউজের কাছে দাবি করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কোনো সনদ নেননি। এমনকি তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি।
তিনি বলেন, আমি দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা থেকে বিবিএ এবং এমবিএ করেছি। তার আগে শুধু এসএসসি এবং এইচএসসির সনদ দিয়ে চাকরি করেছি। সিইও পদে নিয়োগ পেতে এই সনদ দিয়েই আইডিআরএ আবেদন করেছি।
তবে মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডে যোগদানের পূর্বে তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেছেন সেখানে জমা দেওয়া সিভিতে বিএ পাস উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা শুরু থেকেই সনদ বাণিজ্যের জন্য বিতর্কিত। এই অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ২০০৬ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদ অবৈধ ঘোষণা করে।
গত বছর এক বিজ্ঞপ্তিতে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার বিষয়ে ইউজিসি বলে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৯৫ সালে সরকারের অনুমোদন পায়। কিন্তু আইন না মানায় ২০০৬ সালে সরকার এটি বন্ধ করে দেয়।
মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার সনদও বিশ্লেষণ করেছে সোনালী নিউজ। ব্যাচেলর অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন বা বিবিএ সনদ অনুযায়ী তিনি মার্কেটিং বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৪.০০ স্কেলে পেয়েছেন ৩.৪৮। পাস করেছেন ২০০১ সালে। আর সনদ ইস্যু করা হয়েছে ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে। সনদে আইডি/রোল উল্লেখ করা হয়েছে ৯৮১৯১৯। তবে প্রাপ্ত সনদে রোল নাম্বারটির জায়গা অস্পষ্ট থাকায় এটা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রেজিস্ট্রেশন নাম্বার উল্লেখ করা হয়েছে ৯৮১৯। সনদটির সিরিয়াল নম্বর ৯৮।
একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুহাম্মদ সাইদুল আমিন মাস্টার্স অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন বা এমবিএ করেছেন ২০০২ সালে। মার্কেটিং বিভাগে সিজিপিএ ৪.০০ স্কেলে পেয়েছেন ৩.৬৩। তার এই সনদটি ইস্যু করা হয়েছে ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। সনদ দুটি ইস্যুর তারিখ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) তার এই সনদে আশ্বস্ত হতে পারছে না। এ জন্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে রোববার (১১ জুন) মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের পূর্ববর্তী কর্মস্থল ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে এবং হোমল্যান্ড ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী বরাবর চিঠি দিয়েছে আইডিআরএ।
কর্তৃপক্ষের পরিচালক (উপসচিব) মোহা. আব্দুল মজিদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক এসইভিপি ও হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক এভিপি মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের সঠিকতা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাচাই করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে কোম্পানি দুইটিতে নিয়োগের সময়ে তার দাখিলকৃত সকল শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ এবং জীবন বৃত্তান্তের দলিলাদি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ’র একজন কর্মকর্তা বলেন, মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের শিক্ষা সনদের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ইতিমধ্যে আমরা কাজও শুরু করেছি। আশা করছি শিগগিরই এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারবে।
একাধিক সনদের বিষয়ে জানতে মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের সঙ্গে তার অফিসে দেখা করে সোনালী নিউজের প্রতিবেদক। তিনি বলেন, আমার সনদ নিয়ে একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমি শুধু দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা থেকেই বিবিএ এবং এমবিএ শেষ করেছি। এটা দিয়েই সিইও পদের জন্য আইডিআরএ আবেদন করেছি।
তাহলে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে আবেদনের সময় সিভিতে বিএ উল্লেখ কেন করেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই তথ্য সঠিক নয়, আমি ওখানে ইন্টারমিডিয়েট পাসের সার্টিফিকেট দিয়ে আবেদন করেছি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই