ঢাকা: কোভিড মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতেই দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। ফলে অর্থনৈতিক সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, একের পর এক হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক সহিংসতার জেরে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। এরই মধ্যে পণ্যের বাজারমূল্যে ও রপ্তানিতে এসব কর্মসূচির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে তাদের উদ্বেগ বাড়ছে।
শুধু কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই নয়, সম্প্রতি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধাবস্থাও বৈশি^ক অর্থনীতিতে এক রকম অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। দেশের অর্থনীতি যাচ্ছে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে। সব মিলিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি পার করছেন, বলছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি এমএ রাজ্জাক খান রাজ বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের কর্মসূচি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই শুধু নয়, রপ্তানি বাণিজ্যেও বড় বাধা। এসব কর্মসূচির কারণে কাঁচামাল পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে, যা উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অপরদিকে বাজারে পণ্য সরবরাহও বিঘ্নিত হচ্ছে, যা প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যে। এমনটা চলতে থাকলে সঙ্গত কারণেই ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আরও বেড়ে যাবে বলে জানান তিনি।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। লাগাতার অবরোধ কর্মসূচিতে ক্ষতির মুখে পড়ছে এ খাত। এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পোশাক কারখানাগুলোয় খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশপাশি ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদনও। এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতাসংকটে ভুগছে এ খাত। তার ওপর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের। এর ফলে শুধু রপ্তানি খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, দেশের পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের রিজার্ভ কমছে। পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রিজার্ভেও এর প্রভাব পড়বে।
রপ্তানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়। যার প্রভাব পড়ে রপ্তানিতে; ক্ষতির মুখে পড়েন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে দেশের অর্থনীতির ওপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে প্রধাণত পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, হরতালে-অবরোধে অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়ে। এতে অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে বলে শিল্পখাতে উৎপাদনও কমে যায়। বিশেষ করে রপ্তানি খাত হুমকির মুখে পড়ে। সময়মতো ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছানো না গেলে তারা ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেন। এতে একদিকে যেমন ক্রেতা হারানোর শঙ্কা রয়েছে, অন্যদিকে তেমনই বাজার হারানোর ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারে। আর কোনো কর্মসূচি ডাকা হলেও রপ্তানি খাতকে এসবের আওতামুক্ত রাখা উচিত।
রাজধানীর কদমতলী এলাকায় দীর্ঘসময় ধরে ‘ভূইঞা মেটাল’ নামে একটি ছোট্ট কারখানা পরিচালনা করেন মো. ফারুক ভূইঞা। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আগামী দিনগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি। জানান, সম্প্রতি হরতাল-অবরোধের কারণে তার কারখানায় উৎপাদন ৩০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। ফারুক ভূইঞা বলেন, পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়তে হয়। কাঁচামালের সংকট দেখা দেয়। অর্ডার ডেলিভারি দেওয়া যায় না। ডেলিভারি না দিতে পারলে টাকা আটকে যায়। আমার কারখানায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। তাদের চালাতে হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় লাভ দূরে থাক, উল্টো অনেক টাকা গচ্চা যায়।
মার্কেট-দোকান ব্যবসায়ীদেরও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। অবরোধ চলাকালে সহিংসতার আশঙ্কায় অনেকেই দোকানপাট খুলতে পারেন না। কেউ কেউ খুললেও আতঙ্কিত ক্রেতারা মার্কেটে আসেন না।
আসছে শীতের মৌসুম। শীতের কাপড়ের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টারে এখন ব্যস্ত সময় পার করার কথা পাইকারি বিক্রেতাদের। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাজ করছে স্থবিরতা; মার্কেটে ক্রেতা মিলছে না বলে জানান এখানকার ব্যবসায়ীরা।
এ মার্কেটের ‘কমফোর্ট জোন’-এর কর্ণধার দুলাল হোসেন বলেন, শীতের বাজার ঘিরে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছি। অক্টোবর-নভেম্বরে ব্যস্ত সময় পার করতে হয় আমাদের। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতার আতঙ্কে ক্রেতারা আসছেন না। এভাবে চললে ভরা মৌসুমে আমাদের ব্যবসা হারাতে হবে।
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, হরতাল-অবরোধ হলে সেদিন বেচা-বিক্রি হয় না বললেই চলে। যেদিন অবরোধ থাকে, সেদিন দোকান ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়ে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েন।
এমএস