ঢাকা : বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের চাপ দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। ন্যূনতম শ্রম মজুরিকে নিয়ে সাম্প্রতিক শ্রম আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেশটির নতুন শ্রমনীতি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহারের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শ্রমনীতিকে ভিত্তি করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ইতিমধ্যে সরকারকে সতর্ক করেছে। দেশের রপ্তানির প্রধান খাত পোশাকের ওপরই এ খড়গ আসতে পারে। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এ খাত থেকে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। এ আয়ের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে। যদিও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা পায় না। সর্বোচ্চ কর দিয়ে দেশটিতে রপ্তানি করে আসছেন ব্যবসায়ীরা।
তারপরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রভাব পশ্চিমা দেশগুলোতেও পড়ে, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি আসে।
গত ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) মো. সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত চিঠিতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইস্যু করা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ঘোষণা দেওয়া ‘মেমোরেন্ডাম অন অ্যাডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ শীর্ষক সংকলিত রিপোর্টটি সদয় বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, যদিও এই ‘মেমোরেন্ডাম’ মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সব দেশের ওপরই প্রযোজ্য, তবু এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এর অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশ।
রিপোর্টটি প্রকাশের সময় নির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের শ্রম ইস্যুকে উদ্ধৃত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী। এই ‘মেমোরেন্ডাম’ অনুযায়ী, শ্রমবিষয়ক ইস্যুগুলোতে সরাসরি প্রভাব (ইন্টার্যাক্ট/ডিল) বিস্তার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক মিশনগুলো।
এ নীতির ফলে অনেক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপে আগ্রহী মার্কিন কূটনীতিক বা মিশনগুলো উৎসাহিত হতে পারে। দৃশ্যত যদি তারা মনে করে বা বিশ্বাস করে যে, শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তাহলে এ সুযোগকে যেকোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরোপ করা হতে পারে।
এই ‘মেমোরেন্ডামের’ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বহু কারণে উদ্বেগজনক হতে পারে। ‘মেমোরেন্ডামে’ শ্রম অধিকার বিষয়ে যা বলা হয়েছে তার নেপথ্যে আছে রাজনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন উপায়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে তা।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে এটি নিয়ে সরকার ভীত নয়।
বুধবার (২৯ নভেম্বর) বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তার নির্বাচনী এলাকায় রংপুরের সেন্ট্রাল রোডের নিজ বাসভবনে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমেরিকা-ইউরোপ মিলে পোশাক রপ্তানি বন্ধে যে পাঁয়তারা করছে, তা বাস্তবায়ন হবে না।’
তার মতে, রাজনীতি ও ব্যবসা আলাদা জিনিস। এ দুটি দেশ এমন কিছু করবে না, যার প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পড়ে। এজন্য তিনি উদ্যোক্তাদের উদ্বিগ্ন না হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ দূতাবাসের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, “এই ‘মেমোরেন্ডাম’ বাংলাদেশের জন্য একটি সিগন্যাল। কারণ ‘মেমোরেন্ডামে’ বর্ণিত শ্রম ইস্যুর অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে। এই মেমোরেন্ডাম বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের আগে থেকেই বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত।”
তবে ব্যবসায়ীরা এখনো প্রত্যাশা করছেন শ্রম ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞার এ বিষয়টি রাজনীতিকরণ করা হবে না। কারণ বাংলাদেশ সব ধরনের শ্রম আইন মেনে চলছে।
রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমি মনে করি রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়, ইউএসএ এটাকে যেন ট্যাগ না করে। তাহলে দেশের শ্রমিক ও জনগণই এটার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ ব্যাপারে সরকারও যেন সতর্ক থাকে, এটাকে অ্যাড্রেস করে যেন পদক্ষেপ নেয়। আমাদের পক্ষ থেকে সরকারকেও বলেছি। যেসব উন্নত রাষ্ট্র আছে তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার মধ্যে আছি। তারা যা যা চাচ্ছে সেগুলোকে আমরা চিহ্নিত করছি, সমাধানের চেষ্টা করছি।’
নিষেধাজ্ঞা না দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমি এখনো মনে করি কেউ এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেবে না। আমরা শ্রম আইন মেনে চলি। তাদের আইনে বলা আছে, শ্রম আইন লঙ্ঘন করলে তারা ব্যবস্থা নেবে।
তারা আমাদের বিভিন্ন পরিবর্তনের কথা বলে, আমরা সেটি করছি। গত ১০ বছরে শ্রম আইন তিনবার পরিবর্তন হয়েছে। সবসময় শ্রমিকদের পক্ষেই সেই পরিবর্তন হয়েছে। আগে যা ছিল তার চেয়েও ভালো করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে শ্রমনীতি করেছে। সেখানে বলা আছে, যদি সেটি লঙ্ঘন করা হয় তাহলে সেটি প্রয়োগ করা হবে। লঙ্ঘন না করলে তা হবে না।
আমরা এটিও নিশ্চিত করব, আমরা যারা ইউএসএতে রপ্তানি করি তারা যাতে কেউ সেটি লঙ্ঘন না করে।’
ফারুক হাসান বলেন, ‘কোনোদিনই দেশটিতে ডিউটি ফ্রি এক্সেস ছিল না, এখনো নেই। ৯৭ শতাংশই জিএসপির মধ্যে পড়ে। শুধু পোশাক এর মধ্যে নেই। পোশাক পড়েছে ৩ শতাংশের মধ্যে।
আফ্রিকান অনেক দেশের সেখানে ডিউটি ফ্রি এক্সেস আছে, যেখানে শ্রম আইনের বাস্তবায়ন আমাদের চেয়ে অনেক কম। অথচ আমরা কিছুই পাই না। আমাদের গড় শুল্ক সেখানে সবার চেয়ে বেশি। তারপরও আমরা শ্রম আইন মেনে চলছি, আগামীতেও আমরা আরও সতর্ক হব। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেবে না।’
এ ব্যবসায়ী নেতার মতে, যেহেতু ইউএসএ শ্রমিকদের জন্য কথা বলে, তাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৫৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু একই বছর পোশাকের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ কমে ৯ দশমিক ৮২ বিলিয়নে ঠেকেছে।
এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। দেশটিতে পোশাক রপ্তানি কমার প্রবণতা চলতি অর্থবছরও অব্যাহত রয়েছে।
এমটিআই