ঢাকা : সমস্যা জর্জরিত ও দুর্বল ব্যাংকের সংকট কাটিয়ে তোলার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; সমস্যার ধরন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ভাগ করা হবে চারটি ‘শ্রেণিতে’।
পাঁচ সূচকের মাধ্যমে এক থেকে চার পর্যন্ত এসব শ্রেণি বা ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করে সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর মান উন্নয়নের নীতি ঠিক করা হবে।
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) ‘প্রমোম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নামের একটি কাঠামোর আওতায় কোন ব্যাংক কোন ক্যাটাগরিতে যাবে এবং কীভাবে বিশেষ নজরদারি করা হবে তা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশে কার্যরত সব ধরনের দেশি ও বিদেশি ব্যাংকের শাখার উপর ‘পিসিএ’ বাস্তবায়ন হবে। পাঁচ সূচকে লাগাতার পতন হলে সব ক্যাটেগরির ব্যাংকগুলোকে ‘অনিরাপদ’ ও ‘আর্থিকভাবে অস্বাস্থ্যকর বা দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরপর দুই ক্যাটাগরিতে অবনতি হলে তা সবচেয়ে ‘দুর্বল’ বা ‘খারাপ’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
পিসিএ নিয়ে সার্কুলারে বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংক হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যাংকের মান উন্নয়নে পিসিএ এর আওতায় ‘ডিরেক্টিভস অব বাংলাদেশ ব্যাংক-ডিওবিবি বা ডব’ ইস্যু করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বলতা কাটিয়ে ব্যাংকের মান উন্নয়নে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে একীভূত করার মতো পদক্ষেপও নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এমন পদক্ষেপের কারণ ব্যাখ্যায় সার্কুলারে বলা হয়েছে, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং আর্থিক খাতে জনগণের আস্থা ধরে রাখার অংশ হিসেবে সমস্যা প্রকট হওয়ার আগেই ব্যাংকের দুর্বলতা শনাক্ত করা জরুরি। শুরুতেই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিলে ক্ষতি কম হয়। সমস্যা প্রকট হয়ে গেলে তা সমাধানেও বেশি সময় লাগে এবং কষ্টসাধ্য পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, একটি ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া খুবই ব্যয়বহুল এবং জটিল ও বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া। এমন প্রেক্ষাপটে দুর্বল ব্যাংক বা ব্যাংকগুলোর সমস্যা সমাধানে দ্রুত সংশোধনের পদক্ষেপ জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ‘পিসিএ’ এর আওতায় আর্থিক সূচকগুলোর কোনোটিতে অবনতি বা অস্থিতিশীল হলেই তা শনাক্ত করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালক পর্ষদকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাধানের উদ্যোগ নিতে বলবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, আর্থিক সূচকের বাইরেও ব্যবস্থাপনা, মুনাফার পরিবর্তে বড় ধরনের লোকসান, দায় শোধে ব্যর্থতা, বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য ও পরিপালন করতে গড়িমসি, জাল-জালিয়াতির ঘটনা, পরিচালক পর্ষদের অনিরাপদ কর্মকাণ্ড দেখা দেওয়া ব্যাংককে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় আনবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দুর্বল ব্যাংক শনাক্ত ও তার উন্নয়নে নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন এ পদক্ষেপ কতটা কাজে আসবে- এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘‘যত নিয়ম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা আছে তার প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা আগে দেখতে হবে।
নিয়ম শক্তভাবে প্রয়োগ না হলে কোনো ফল আসবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ব্যর্থতায় পুরনো কিছু নীতির সংশোধন হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যে নীতিমালা ও ক্ষমতা আছে তা দিয়েই ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। ব্যাংকিং খাতে এটিই সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে আছে।
নতুন পদক্ষেপে ক্যাটাগরি নির্ধারণের এ প্রক্রিয়ায় পুরো ব্যাংকিং খাত চাপের মুখে পড়তে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
যে পাঁচ সূচক দিয়ে ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হবে সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সার্কুলারে। সেগুলো হচ্ছে-ব্যাংকের সিআরএআর (ক্যাপিটাল টু রিক্স ওয়েটেড অ্যাসেটস রেশিও), টিয়ার-১ ক্যাপিটাল রেশিও, কমন ইক্যুইটি টিয়ার-১ (সিইটি১) রেশিও, নিট নন পার্ফমিং লোন (এনপিএল) বা নিট খেলাপি ঋণ এবং করপোরেট গর্ভনেন্স বা সুশাসন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঠিক করা সূচক অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ হলেই সেটি দুর্বল ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে ক্যাটেগরি-১ এ স্থান পাবে।
খেলাপি ঋণ ৫-৮ শতাংশের নিচে থাকলে ক্যাটেগরি-১, ৮ থেকে ১১ এর হলে ক্যাটেগরি-২, ১১ থেকে ১৪ এর নিচে ক্যাটেগরি-৩ এবং ১৪ শতাংশের উপরে হলে ওই ব্যাংককে ক্যাটেগরি-৪ এ রাখা হবে।
দুর্বল ব্যাংক হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যাংকের মান উন্নয়নে ‘পিসিএ’ এর আওতায় সংশোধনে নির্দেশনা ‘ডিওবিবি’ ইস্যু করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর তা আনুষ্ঠানিকভাবে ওই ব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হবে।
সার্কুলারের বলা হয়েছে, পিসিএর আওতায় প্রতিটি ব্যাংকের উন্নয়নে একটি চুক্তি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চুক্তি অনুযায়ী, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের অপসারণ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন কোনো কর্মকর্তাকে নিয়োগও দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কোনো ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন করার পাশাপাশি বিশেষ নিরীক্ষা চালাতে ‘নিরীক্ষক’ নিয়োগ দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের অনুমতি স্বাপেক্ষে পিসিএর আওতায় নেওয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২৪ সালের ব্যাংকগুলোর নীরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে আসা তথ্য থেকে পাঁচ সূচকের মান অনুযায়ী ক্যাটাগরি ঠিক করা হবে। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে বাস্তবায়ন হবে।
এরপর সময়ে সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়-সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে সার্কুলারে বলা হয়েছে।
এমটিআই