ঢাকা : দীর্ঘদিন স্থবির থাকা শেয়ারবাজারে ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকরে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। লেনদেনেও ছোট ছোট রেকর্ড করেছে ইতোমধ্যে যা দীর্ঘদিন পর আশার আভাস বলা যায়। এরই মধ্যে শীর্ষ টার্নওভারের বিবেচনায় ২০টি ব্রোকার হাউজকে পুরস্কৃত করেছে ডিএসই ব্রোর্কাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)। যার মধ্যে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড। শেয়ারবাজারের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটির অবদান চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীর প্রায় ৬০ শতাংশ ট্রেডিং হয় এই প্রতিষ্ঠানে।
এছাড়াও গবেষণা, লিটারেসি অ্যাওয়ারনেস, গুড গভার্নেন্স মেইনটেইন এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেছেন ব্র্যাক ইপিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা (সিইও) আহসানুর রহমান।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সোনালীনিউজের স্টাফ রিপোর্টার আবদুল হাকিম...
সোনালীনিউজ: ফ্লোরপ্রাইস তোলার পরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে কিনা?
আহসানুর রহমান: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সব সময় চায় বাজার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় থাকুক। বাজারে ফ্লোরপ্রাইস থাকা এটা কেউ প্রত্যাশা করে না। যার কারণে ফ্লোরপ্রাইস আরোপ থাকা অবস্থায় প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় তেমন কোন বিনিয়োগ আসেনি। তবে ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেওয়ার পর থেকে আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অনেক আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। এমন রেসপন্স বিগত এক বছরেও পাইনি। দীর্ঘ দিন ফ্লোরপ্রাইসের কারণে সব কিছু একদম স্থবির ছিল। ২০১৮ সালের পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সেলগুলো কমেছে আসছে। বর্তমানে ফ্লোরপ্রাইস তোলার পর থেকে ক্রয় আদেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয় প্রবণতা বাড়ছে। বাজারের গতিশীলতা স্থির থাকলে এর পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
সোনালীনিউজ: বর্তমানে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কেমন দেখছেন?
আহসানুর রহমান: ফ্লোরপ্রাইস তুলে নেওয়ার পর ব্র্যাক ইপিএলের চিত্র যদি বলি, দেখা যাবে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ বেড়েছে। এখন ফান্ড ফ্লো হচ্ছে। আমাদের হাউজে গত দেড় মাসের নেট বাই দেখে বুজতে পারলাম ফান্ড ফ্লোটা খুবই পজেটিভ। অনেক মৌলিক শেয়ারে ভালো ভালো ফ্লো হচ্ছে। সহজ ভাষায় যদি বলি শেয়ারবাজারে এখন কনফিডেন্স ফিরে এসেছে।
তবে আমাদের বাজারে সবাই ইনভেস্টর আনে কিন্তু ভালো ইনভেস্টর তৈরি করে কত জন সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ভালো ইনভেস্টর তৈরি করতে পারলে বাজারের গ্রোথ বাড়বে। এতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের জায়গায় তৈরি হবে এবং বাজারের প্রসার বাড়বে। এজন্য আমাদের উচিত বাজারে ভালো ইনভেস্টর তৈরি করা। এক্ষেত্রে রিসার্চ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্র্যাক ইপিএল সব সময় ভালো ইনভেস্টর তৈরিতে কাজ করে আসছে এবং ভবিষতে আমাদের কাজের প্রসার আরও বাড়বে।
আমাদের বাজার মার্জিন ঋণের জন্য এখনও প্রস্তুত না। বিনিয়োগকারীরা প্রস্তুত না হয়েই মার্জিন ঋণ নিয়ে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ ব্যাংক যখন ঋণ দেয় তখন সার্ভে করে দেখে তার এই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে কিনা। কিন্তু আমাদের বাজারে তেমন কোন প্রক্রিয়া নেই। যে মার্জিণ ঋণ নেয় তার কি সক্ষমতা আছে? যাছাই না করেই দেওয়া হয়। এবং বিনিয়োগকারীও তা সহজে পেয়ে লুফে নেয়। এক পর্যায় দেখা যায় যে প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে তাকে তো ফেরত দিতে হয় এর মধ্যে বিনিয়োগকারী লস খেয়ে বসে থাকে। এর ফলে এসব বিনিয়োগকারী বাজার বিমুখ হয়ে যায়। এজন্য বলা যায় মার্জিন ঋণ দেওয়ার আগে বিনিয়োগকারীর সক্ষমতা যাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীরও উচিত জেনে বুঝে তার পর মার্জিণ ঋণ নেওয়া।
সোনালীনিউজ: ভালো পোর্টফোলিও ম্যানেজের ক্ষেত্রে ব্র্যাক ইপিএল কি ধরণের পরামর্শ দিয়ে থাকে?
আহসানুর রহমান: আমরা সব সময় চেষ্টা করি বিনিয়োগকারীকে সঠিক সময় সঠিক তথ্যটা দিতে। আমাদের দক্ষ একটি রিসার্চ টিম রয়েছে। সামনে আরও একটি দক্ষ রিসার্চ টিম গঠন করা এবং স্মল ও মিডিয়াম ক্যাপ নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা আছে। আমাদের সব সময় চেষ্টা থাকে কোম্পানির সঠিক তথ্যটা বিনিয়োগকারীর কাছে তুলে ধরা। এসব প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে ব্রাক ইপিএল ক্লায়েন্টদের আকৃষ্ট করে থাকে। আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীদের থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনেক সতর্ক, যার কারণে তারা রিসার্চকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এছাড়াও সঠিক তথ্য পেয়ে তারা বিনিয়োগ করে থাকে। এজন্য আমাদের চেষ্টা থাকে আপডেট এবং কোম্পানিগুলোর সঠিক তথ্যটা বিনিয়োগকারীর সামনে উপস্থাপন করতে। এর মাধ্যমে যেমন তাদের আগ্রহ তৈরি হয় তেমনি বিশ্বস্ততা তৈরি হয়। আর ব্র্যাক ইপিএল বিনিয়োগকারীকে সব জানানোর পর বিনিয়োগ করতে আকৃষ্ট করে থাকে।
সোনালীনিউজ: ডিবিএ’র সেরা ব্রোকার হাউজ পুরস্কার পেয়ে আপনার অনুভুতি কি?
আহসানুর রহমান: প্রথমে বলবো সেরা ব্রোকার পুরস্কার কার্যক্রমটা ডিবিএ’র দারুণ একটা উদ্যোগ ছিল। এখন তো শুধু টার্নওভারের ক্ষেত্রে পুরস্কৃত করেছে, এরপর প্রত্যাশা করবো সব ক্যাটাগরিতে যেন পুরস্কার দেওয়া হয়। আমাদের আশা থাকবে ব্রাক ইপিএল বিনিয়োগকারীদের ভালো সার্ভিস দিয়ে সব ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হতে। সেটা হতে পারে সেরা রিসার্চ হাউজ বা বেস্ট ট্রেডিং প্লাটফর্ম অথবা কাস্টমার সার্ভিসে বেস্ট ইত্যাদি। আমরা সব সময় ক্লায়েন্টকে বেস্ট সার্ভিস দিতে চেষ্টা করি। ভালো কাজ উপহার দিতে পারলেই পুরস্কার পাওয়া যাবে। সুতারাং আমাদের ফোকাস বেস্ট সার্ভিস অব্যাহত রাখা।
সোনালীনিউজ: ডিজিটাল সার্ভিসের ক্ষেত্রে আপনাদের অগ্রগতি কেমন?
আহসানুর রহমান: ডিজিটাল কার্যক্রমের কথা বলতে গেলে ইতোমধ্যে আমরা একটা অ্যাপ তৈরি করছি যার মাধ্যমে বিনিয়োগকারী তার পোর্টফোলিও ম্যানেজসহ সব কিছু সহজে করতে পারবে। এছাড়াও আমাদের ওএমএস (অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) এর কার্যক্রম অব্যাহত আছে। পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েই আমরা এই কার্যক্রমটি চালু করতে অপেক্ষা করছি। ডিজিটাল বুথ নিয়েও কাজ চলমান তবে আমরা শুধু ডিজিটাল বুথে সীমাবদ্ধ নই। ওভারোল ডিজিটাল সার্ভিস নিয়ে ফোকাস করছি। ওএমএসের কার্যক্রম এখন টেস্টিং পর্যায়ে আছে। টেস্টিংয়ে যতদিন ওএমএসের কাজটা সহজলভ্য না হয় আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করবো না। টেস্টিং পর্যায়ে থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হলে এটা সচল করবো।
ইতোমধ্যে আমরা ডিএসইর ফিক্সড সার্টিফিকেট পেয়েছি। টেস্টিং কার্যক্রম সফলতা পেলেই আমরা ওএমএসে কাজ শুরু করবো। আমাদের ডিজিটাল সার্ভিসটা এমনভাবে তৈরি হবে বিনিয়োগকারী আমাদের কাছে আসতে হবে না। এখন যেমন বিনিয়োগকারীরা এসে পোর্টফলিও ম্যানেজ করতে হয় তখন আর আসতে হবে না। ঘরে বসেই সব ম্যানেজ করতে পারবে। অ্যাপের মধ্যেই সব কিছু দেখতে পারবে। এছাড়াও অনেক সার্ভিস আমরা এর মধ্যে যুক্ত করবো। সব কাজ ক্লায়েন্ট এক জায়গায় করতে পারবে এমন পরিকল্পনা নিয়েই আমাদের ডিজিটাল প্লাটফর্ম সাজানো হচ্ছে।
সোনালীনিউজ: আপনারা ইক্যুইটি নোট করে থাকেন, সেটা কোন কোন ক্ষেত্রে করা হয়?
আহসানুর রহমান: আমরা আইপিও’র ক্ষেত্রে ইক্যুইটি নোট করে থাকি। এছাড়াও ইনভেস্টরদের জন্য প্রতি কোয়াটারে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি কোম্পানির ভ্যালুয়েশন করে থাকি। সেটা প্রতি কোয়াটারে একটা ফ্লাশ নোট আসে, যেটা আমরা করি। যেমন এই কোয়াটারে কোম্পানির ব্যাবসায় কি কি ফ্যাক্টর ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে থাকি। এই রিপোর্ট আমরা প্রতি কোয়াটারে করি আর আইপিও নোট শুধু আইপিও বেস করে থাকি। তবে এর পরিধিটা আমাদের বাড়ছে না। আমাদের গভার্নেন্সে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। আমরা ব্রোকার হাউজ হিসেবে রিসার্চ টিম দিয়ে আরও অনেক কোম্পানির ভ্যালুয়েশনের আন্ডারে আনতে পারবো। এর জন্য প্রযোজনা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা। যা বাজারের গতিশীলতা বাড়াবে।
সোনালীনিউজ: বাজার উন্নয়নে ভবিষতে ব্র্যাক ইপিএল কি ধরণের ভুমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করছেন?
আহসানুর রহমান: একটি ব্রোকার হাউজের শক্তি থাকা উচিত তার রিসার্চে, গভর্নেন্সে এবং তার ট্রেডিং প্লাটফর্মে। ট্রেডিং প্লাটফর্মটি কতটুকু সহজলভ্য ইউজার ফ্রেন্ডলি এটা অনেক গুরুত্ব বহন করে। এসব বিষয়গুলো যদি কোন ব্রোকার হাউজে ফলো করে তাহলে পুরো মার্কেটে এর ভালো প্রভাব পড়ে। আমরা চেষ্টা করবো মার্কেটে একটা এডুকেটর ইনভেস্টর বেস তৈরি করতে। মার্কেটে যদি ইনভেস্টর বেস তৈরি হয়, বিনিয়োগকারী সতর্ক হবে। এতে তারা বুঝে শুনে বিনিয়োগ করবে। আর এটা সম্ভব যদি ব্রোকার হাউজগুলো তার কাজ যথাযথভাবে করে।
এক্ষেত্রে রিসার্চ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইনভেস্টররা যদি সব কিছু ভালো শিখার সুযোগ পায় তাহলেই একটা ভালো মার্কেট তৈরি হবে। সব কিছু যখন বিনিয়োগকারীরা অবগত থাকবে তারা যে সিদ্ধান্তই নিবে জেনে বুঝে নিবে। এর ফলে মার্কেটে ডিমান্ড তৈরি হবে ইনভেস্টরদের থেকে। এধরণের ইনভেস্টর তৈরি করতে হবে ব্রোকার হাউজের দক্ষ রিসার্চ টিমের মাধ্যমে।
ইতোমধ্যে ব্র্যাক ইপিএল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ড এডুকেশন নামে একটা প্রচারণা চালাচ্ছে। যেখানে বন্ডের উপর লিটারেসি ইম্প্রুভ করার জন্য কাজ করছি। শুধু বন্ড নয় ইক্যুইটি নিয়েও আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নভাবে কাজ করছি। সেখানে আমাদের একটা সেগমেন্ট আছে যা শুধু লিটারেসিকে ইম্প্রুভ করার জন্য। আমাদের চেষ্টা বিনিয়োগকারীকে কোম্পানি সম্পর্কে ভালো ইনফরমেশন দেওয়া যাতে এই তথ্য নিয়ে তারা বিনিয়োগ করতে পারে।
এমটিআই