ঢাকা : আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে স্বেচ্ছায় কিছু ব্যাংককে একীভূত করার সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি জানিয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে।
এরপর আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী, যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষ্য, কোনো ব্যাংক একীভূত হলেও তার আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না। আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ করে কোন পদ্ধতিতে ও কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যাংক একীভূত হবে, তা নিয়ে প্রণয়ন করা হবে নীতিমালা।
মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংক একীভূত হওয়া নিয়ে নানা ধরনের অনুমানভিত্তিক কথা হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংক একীভূত হোক না কেন, এতে আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থও দেখা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, যেসব ব্যাংক একীভূত হবে, ওই ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য ভালো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এরপরই একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। ব্যাংক একীভূত হলে তা হবে যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। একীভূত হলে ভালো ব্যাংক যাতে দুর্বল না হয় এবং দুর্বল ব্যাংক যাতে ভালো হয় এ দুটিই দেখা হবে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ব্যাংকগুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ তালিকাভুক্তি প্রসঙ্গে মেজবাউল হক বলেন, এটা ব্যাংকের স্বাস্থ্য দেখার কোনো সঠিক পদ্ধতি নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ নানা সময়ে ব্যাংকের তালিকা করে থাকে। এই তালিকাটা ধারণাভিত্তিক। যেখানে কোন পরিস্থিতি হলে কী হবে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়। ব্যাংকের স্বাস্থ্য দেখার একমাত্র উপাদান নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন, যা ক্যামেলস পদ্ধতির মাধ্যমে দেখা হয়।
ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে এমন আলোচনার মধ্যে ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে।
এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দেয়, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংক সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ব্যাংকগুলোর রেড-গ্রিন-ইয়েলো জোনে অবস্থান নিয়ে প্রতিবেদনের বিষয়ে এবার ব্যাখ্যা দিল ব্যাংলাদেশ ব্যাংক।
মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দুর্বল ও সবল ব্যাংকের তালিকা রিসার্চের জন্য করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি ডিপার্টমেন্ট ব্যাংকগুলোর ছয়টি কম্পোনেন্ট নিয়ে এসব ব্যাংকের তালিকা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই গোপন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি।
তবে প্রতিবেদনে ৫৪ ব্যাংকের অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়। যেখানে ১২টি ব্যাংকের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক, যার ৯টি ইতিমধ্যে রেড জোনে চলে গেছে। ইয়েলো জোনে রয়েছে ২৯টি ব্যাংক আর ৩টি ব্যাংকের রেড জোনের খুব কাছাকাছি অবস্থান।
প্রতিবেদনটির বিচারে রেড জোনের ব্যাংকগুলো সবচেয়ে খারাপ (পুওর) এবং ইয়েলো জোনের ব্যাংকগুলো দুর্বল (উইক)। আর গ্রিন জোনের ব্যাংকগুলো ভালো মানের (গুড); অর্থাৎ দেশে এখন সবলের চেয়ে দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি। প্রতিবেদনে লাল ও হলুদ জোনে থাকা ব্যাংকগুলোর বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ভালো অবস্থায় রয়েছে প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সীমান্ত ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক আল ফালাহ, উরি ব্যাংক, এইচএসবিসি, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, সিটি ব্যাংক এনএ, হাবিব ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
রেড জোনে থাকা ব্যাংকগুলো হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক।
তিনটি ইয়েলো জোনে থাকলেও রেড জোনের কাছাকাছি থাকা ব্যাংকগুলো হলো বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), সোনালী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
ইয়েলো জোন বা হলুদ সীমায় থাকা ২৯টির মধ্যে ২৬টি ব্যাংক হলো, আইএফআইসি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, আল আরাফাহ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা, গ্লোবাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, সাউথ বাংলা, মধুমতি, ঢাকা ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক।
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে মেজবাউল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি কম্পোনেন্ট নিয়ে দুর্বল- সবল ব্যাংকের তালিকা করেছে। এটা আমাদের নিজেদের গবেষণার জন্য করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার জন্য আমাদের এ রেটিং করা হয়নি। তা ছাড়া কোন ব্যাংক দুর্বল এটা তো সবার জানা। শেয়ারবাজার থেকেও চিত্র আপনারা দেখতে পান।’
মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের সব রিপোর্ট পাবলিকের (জনসাধারণের) জন্য করা হয় না। বেশ কিছু রিপোর্ট জাতীয় স্বার্থে গোপন করতে হবে। ব্যাংকগুলোর ওপর ক্যামেলস রেটিং কখনো পাবলিক হওয়ার জন্য নয়, এটা গোপনীয় আমাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট বিভিন্ন কম্পোনেন্ট নিয়ে এসেসমেন্ট করে। রেগুলার ফাইন্যান্সিয়াল রিস্ক ম্যানেজমেন্টের জন্য করা হয়, এটা প্রকৃত হেল্থ ইন্ডিকেটর নয়।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে শ্রেণীকরণ করতে একটা পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক করেছি। যেখানে চারটি ক্যাটাগরিতে ব্যাংকগুলোকে মূল্যায়ন করা হবে। চলতি বছরের ব্যালেন্সশিটের ওপর ভিত্তি করে এটা করা হবে। যেটা কার্যকর হবে ২০২৫ সালের মে মাস থেকে।
মার্জারের বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী এক বছরে কিছু ব্যাংক মার্জারের (একীভূত) পরিকল্পনা রয়েছে। মার্জারের বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্বতাও থাকবে মার্জারের ক্ষেত্রে। এখানে দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংক হতে পারে আবার সবল ব্যাংক আরও সবল ব্যাংক হতে পারে।
এমটিআই