ঢাকা: করোনার মহামারিতে যেখানে একটা সময় কোরবানির পশু বেচাকেনা জমেছিল, সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অনলাইন হাটে আগ্রহ হারাতে বসেছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
হাটে গিয়ে দেখেশুনে আগের মত দর কষাকষি করে ‘ভালো দামে’ পশু কিনছেন বেশির ভাগ মানুষ। তবে অনলাইনে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাদের অনেকে এখনও সেই মাধ্যমেই ভরসা রাখছেন।
২০২০ সালে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ), ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), আইসিটি বিভাগের এটুআই ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রথমে ‘ডিএনসিসি ডিজিটাল হাট’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২১ সালে এ হাটের নাম দেওয়া হয় ‘ডিজিটাল হাট’। এবারও ডিজিটাল হাটে কোরবানির পশুর বেচাবিক্রি হচ্ছে।
ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, এবছর গত বছরের তুলনায় ডিজিটাল হাটের বেচাকেনা কম; তবে একেবারে চলছে না যে তা নয়। সারাদেশে কত বেচাকেনা হয়েছে সেই হিসাব এখনও প্রস্তুত করা হয়নি। অনেকেই নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করছেন, তাদের আর ডিজিটাল হাটে আসতে হচ্ছে না।
সারাদেশের ৬৬৮টি হাটকে ডিজিটাল হাটের সঙ্গে কানেক্ট করা হয়েছে। ওগুলোর কোনো তথ্য নেওয়া যায়নি। কারণ সবাই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গরু বিক্রি করায় আমাদের আর বোঝার সুযোগ থাকছে না। শুরুর দিকে আমরা ইক্যাবের সদস্য ও ডেইরি ফার্মস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম যেমন সাদিক অ্যাগ্রো, অ্যাগ্রো মোকাম, বেঙ্গল মিট-এদের লিংক শেয়ার করা ছিল আমাদের হাটে। আমরা মনিটরিং করছিলাম। এবার সেটা করা যাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ের ডেটা পাওয়া যাচ্ছে না।
শোভন বলেন, অন্যবছর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর তাদের মাঠ পর্যায়ের তথ্য আমাদের দিত। এবার সেটাও হচ্ছে না। তাই হিসাব কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের সদস্যদেরও আগ্রহ কম। অথচ গতবছর আমরা অনলাইন থেকে ৫৬ হাজার গরু বিক্রির তথ্য পেয়েছিলাম।
কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এবার এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি, যা গতবারের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি বেশি। চাহিদা এবারও এক কোটি ৭ লাখ হওয়ায় চাহিদার তুলনায় ২২ লাখ পশু বাড়তি আছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
ক্রেতার চোখে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম
ঢাকার একটি গরুর ফার্ম থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছেন বারিধারার কাওসার হাবিব। তিনি বলেন, সময় স্বল্পতার কারণে গরুর হাটে যেতে পারেননি তিনি।
'কয়েক বছর হাটে গিয়ে গরু কিনেছি, কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে ঠকে গেছি। পরিচিত এক বন্ধুর আত্মীয়র ফার্ম, উনি গরুর ওজন, দাম যা বললেন, সেটার সাথে মোটামুটি নেগোশিয়েট করে কিনে ফেললাম। গরু রাখা বা দেখভালের কেউ না থাকায় ওখানেই গরু থাকবে। ঈদের দিন ভোরে আমাকে গরু হোম ডেলিভারি দিবেন উনারা।'
অনলাইনে যেভাবে বেচাকেনা
ওয়েবসাইট বা ফেইসবুকে গরুর সম্পূর্ণ বিবরণ থাকে। অনেকক্ষেত্রে প্রাণীটির ছোট ছোট স্টোরি বা ভিডিও থাকে। কেউ কেউ ইউটিউব চ্যানেলেও গরুর ভিডিও দিয়ে থাকেন। এসব দেখে ক্রেতারা যোগাযোগ করেন। তারপর ক্রেতা খামারে গরু দেখতে যান। গিয়ে পছন্দ হলে দরদাম করে। তবে এমন অনেক ক্রেতা আছে, যারা পরিচিত মানুষদের বা নির্ভরযোগ্য খামার থেকে গরু কেনেন। সেক্ষেত্রে আস্থা নিয়ে সংকট না থাকায় অনলাইন বা ফোনে ক্রয়াদেশ দেন।
পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাংক পেমেন্ট বেশি হয়, ক্যাশও দেন অনেকে। সাধারণত খামার মালিকরা গরুর দামের ভেতরেই ডেলিভারি খরচা রেখে দেন। ঢাকায় খামারগুলো কোরবানির ২-৩ দিন আগে থেকে ডেলিভারি শুরু করে। ট্রাকে করে গরু পাঠানোর সময় ওই ২-৩ দিনের খাবারও দিয়ে দেন খামারি। অনেকেই আবার অনলাইনে ধারণা নিয়ে খামারে গিয়ে লাইভ ওয়েট দেখে সরাসরি ক্রয়াদেশ দিয়ে থাকেন।
নুরুল আলম মিলন নামের ঢাকার একজন বাসিন্দা জানান, প্রতিবছর তিনি ঢাকায় কোরবানি করেন। গেল তিন বছর অনলাইন থেকে গরু কিনে কোরবানি দিয়েছিলেন। তবে এবার ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে কোরবানি দেবেন। তাই গ্রাম থেকেই গরু কেনার চিন্তা করছেন।
গত বছরের মত এবারও কোরবানির জন্য অনলাইনে গরু খুঁজছেন ঢাকার মিরপুরের রুম্মান রশিদ। বেসরকারি এই চাকরিজীবী বলেন, কয়েকটি ওয়েবসাইট ঘুরলেও এখনো পছন্দসই গরু চূড়ান্ত করতে পারছেন না।
যেসব পছন্দ হচ্ছিল, সেগুলো সবই বিক্রি হয়ে গেছে। আরও কয়েকদিন আছে। পছন্দের সঙ্গে বাজেট অনুযায়ী পেয়ে যাব আশা করি। রুম্মন রশিদ বলেন, গরু সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় তিনি অনলাইনেই ভরসা রাখেন। তাতে বাজারে যাওয়ার ভোগান্তি এড়ানোর পাশাপাশি মনে 'ঠকে যাওয়ার ভয়' থাকে না।
যা বলছেন বিক্রেতারা
সরকারি ডিজিটাল হাটে এবার ২৫টি গরু এনেছেন নরসিংদীর সুমন মিয়া। প্রতিনিয়ত ক্রেতারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
তিনি বলেন, মানুষ আসলে সরাসরি বাজারে গিয়ে দেখে গরু কিনতে চায়। তারপরও অনলাইনে আস্তে আস্তে আস্থা বাড়ছে। ওজন দেখে কিনতে পারছে, বাড়িতে গরু চলে যাচ্ছে- ভোগান্তি যারা এড়াতে চান, তারাই এখানে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
গতবার থেকে কোরবানির গরু বিক্রি হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আড়ৎ-এ। এবারও সেখানে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আড়ৎ স্বত্বাধিকারী আরিফুজ্জামান তুহিন বলেন, এখন পর্যন্ত সাতটি গরু কোরবানির জন্য বুক হয়েছে। ক্রেতাদের কেউ পরিচিত নন। তারা বিভিন্নভাবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
নিয়ম অনুযায়ী ক্রেতাদের চাহিদামত সময়ে তাজা গরু বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসব। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে আরও সাতটা গরু বিক্রির প্রস্তুতি আছে।
মানিকগঞ্জে ২০১৮ সাল থেকে কান্ট্রিফিল্ড নামে একটি গরুর খামার চলছে। কোরবানির জন্য এবার সেখানে প্রায় ৫০০ গরু ও অন্যান্য পশু লালনপালন করা হয়েছিল। কোরবানির চারদিন আগেই সব পশু বিক্রি হয়ে গেছে।
খামারের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক গোলাম আজম সরকার বলেন, আমাদের পরিচিত জনরাই গরু কিনতে আসেন। পরিচিতি কাস্টমারদের থেকে খবর পেয়ে অনেকে অনলাইন থেকে কিনেছেন।
অনলাইনে প্রায় ১০০ গরু বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি।
গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার খামার আলমগীর রেঞ্জের জিএম (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) মোহাম্মদ রাসেল জানান, এবার ভালো সেল হচ্ছে। প্রায় ৯০০ গরু প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ প্লাস সেল হয়ে গেছে। অনলাইনে তেমন কোনো সেল নেই।
তবে ফেইসবুকে কিছু গরু বিক্রি হচ্ছে। অনেকে অনলাইন থেকে কিনে ডেলিভারি নিয়ে নিচ্ছে। আবার অনেকে অনলাইনে দেখেশুনে সরাসরি এসে গরু কেনে। অল্পকিছু মানুষ সরাসরি না এসে অনলাইনে কেনাকাটা শেষ করেন। বলা যায়, ১০০ থেকে ১৫০টি গরু পুরোপুরি অনলাইনে সেল হয়েছে।
পাবনার একদল তরুণ সারাদেশে গরু সরবরাহ করেন 'গরুর হাট' ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। এই হাটের একজন উদ্যোক্তা শরীফ সরকার বলেন, অনলাইনে বিক্রিতে ভালো সাড়া পেলেও ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর গাড়ি নিয়ে জটিলতার কারণে এবার তারা গরু কম এনেছেন, সবগুলোই ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।
'ওয়েবসাইটের পাশাপাশি আমরা ইউটিউবেও গরু দেখাই। সেখান থেকেই বেশি ক্রেতা আসে। আমাদের ক্রেতা মূলত ঢাকার। সেখানে পাঠাতে গেলে গাড়ি নিয়ে আমাদের ঝামেলা হয়। সেজন্য এবার গরু কম এনেছি। সবগুলোই বিক্রি হয়ে গেছে।'
ফেইসবুকে ২০২২ সাল থেকে গরু বিক্রি করছে ফ্রেশি ফার্ম। নওগাঁর এই গরুর খামার থেকে ঈদে অনলাইনের মাধ্যমে সারাদেশেই গরু বিক্রি করা হয়। ফ্রেশি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ জানান, তাদের বেশিরভাগ গরু সরাসরি বিক্রি হয়। তবে অনলাইনে বিক্রির জন্যও কিছু গরু রাখেন।
এবার সাড়ে তিনশ গরু অনলাইন বাজারের জন্য রেখেছি। ইতোমধ্যে আড়াইশ গরু বিক্রি হয়ে গেছে।এই খামারি জানান, অনলাইন বাজারে আনা তাদের গরুর দাম রয়েছে ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত।
প্রয়াস অ্যাগ্রো ফার্মের ৪০ শতাংশ গরুই এবার অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। এই ফার্মের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইফতেখার হোসেন রিফাত বলেন, এবারের কোরবানির ঈদে তারা আগের বছরের তুলনায় বেশি সাড়া পাচ্ছেন।
আমাদের রিপিট কাস্টমার বেশি। এবার আলহামদুলিল্লাহ ভালো সেল হচ্ছে। অনলাইন, অফলাইন- দুভাবেই বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনে ৪০% বিক্রি হলে, সরাসরি হচ্ছে ৬০%।
অনলাইনে ভাটা কেন
ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, “ক্রেতাদের আগ্রহ থাকলেও বিক্রেতাদের আগ্রহ নেই। তারা গরু বিক্রি নিয়ে কোনো টেনশন করছেন না। হাট বা খামার থেকে গরুগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
তারা সরাসরি বিক্রি করতে গেলে কাস্টমার বুঝে দাম কমবেশি করতে পারে। সকাল-বিকাল দাম আপডাউন করে। কিন্তু ডিজিটাল হাটে বিক্রি করতে গেলে একটা প্রাইস ফিক্সড করতে হয়। ফলে দরকষাকষির সুযোগ কম থাকে।
ডিজিটাল হাটের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সেখান থেকে ৫৬ হাজার ৮২১টি পশু বিক্রি হয়েছিল, যার বাজার মূল্য ছিল ৪২২ কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৫৭ টাকা। এরমধ্যে গরু-মহিষ ছিল ৪৭ হাজার ৭৫৭টি এবং ছাগল-ভেড়া ছিল ৯ হাজার ৬৪টি।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদিক এগ্রোর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইমরান হোসাইন বলেন, ২০২০ সালে কোভিডের মধ্যে অনলাইনে খুবই ভালো সেল হয়েছে। সারাদেশে প্রায় চার লাখ পশু সেল হয়েছে ওই বছর। কোভিড চলে যাওয়ার পর অনলাইন তেমন পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি।
'এখন সরকারি প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল হাটও নষ্ট হয়ে গেছে। সাদিক এগ্রোর কিছু নিজস্ব অনলাইন পেইজ আছে। প্রবাসীরা এখান থেকে গরু কিনে বাড়িতে তাদের বৃদ্ধ বাবা-মার জন্য পাঠিয়ে দেন। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট গেটওয়ে রয়েছে। আমরা একেবারে প্রস্তুত করে বাসায় পাঠিয়ে দিই।'
ইমরান বলেন, “গত বছর ১২৬টি গরু ও ২২০টির মত ছাগল জবাই করে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। এ বছরও সেভাবেই যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৬৫টি গরু ও ৩০০টি ছাগলের অর্ডার এসেছে।
ছোট আকারের গরুগুলো অনলাইনে বেশি বিক্রি হয়, এক থেকে দেড় লাখের মধ্যে। ডিজিটাল হাট এবার ওভাবে অ্যাকটিভ আছে বলে মনে হয় না।
জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, এবার অনলাইনে ৫ লক্ষাধিক গরু বিক্রি হয়েছে।
অনলাইনে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে গরু দেখে ক্রেতারা গরু কিনছে। এছাড়া অনলাইনে গরু দেখার পর সরাসরি দেখেও অনেকে গরু কিনেছে এবার। গত দুই বছরের তুলনায় অনলাইনে এবার সাড়া পাওয়া গেছে বেশি।
এবার ডিজিটাল হাটের ক্ষেত্রে সরকার তেমন পৃষ্ঠপোষকতা করেনি-ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে ডিজি রেয়াজুল বলেন, "কিছু শুরু হলে তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হয়। এখন অনলাইন বাজার স্বাবলম্বী হয়ে গেছে। আমরা এটিকে স্বাধীন করে দিয়েছি, আপনারা নিজেদের মত করেন।
যারা কিনে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে, তারা দ্বিতীয়বার আর বাজারে যাবে না। অনলাইন থেকে কিনবে। যারা আস্থা অর্জন করবে, তাদের ব্যবসা ভালো হবে। আমরা কাউকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলাম, দেখা গেল সে প্রতারণা করছে- এসব ঝুঁকিও তখন তৈরি হবে।
এআর
আপনার মতামত লিখুন :