ঢাকা : বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। সরকারি হিসাব বলছে, দুই বছরের বেশি সময় দেশের গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি।
অথচ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা যে খাদ্যপণ্য, সেটি উৎপাদনে জড়িত কৃষকরা পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। যদিও শিল্প ও সেবা খাতের অন্যান্য পেশার তুলনায় কৃষকদের মজুরি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। তারপরও দেশের কৃষকরা কৃষি ছেড়ে অন্য পেশা খোঁজায় মন দিয়েছেন। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
দেশের মজুরির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কৃষি খাতে মজুরি ধারাবাহিকভাবেই শীর্ষে রয়েছে। আগস্টে তা বেড়েছে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। একই সময়ে শিল্প খাতের মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, সেবা খাতের ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বিবিএসের আরেকটি ত্রৈমাসিক জরিপ শ্রমশক্তি জরিপের জুন শেষের তথ্য বলছে, মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি হলেও গত এক বছরে দেশের ২ লাখ ৩০ হাজার কৃষক পেশা ছেড়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রভাবে কাজ হারাচ্ছেন কৃষকরা। অথচ এ সময়টায় গ্যাস-বিদ্যুতের পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রা সংকটের কারণে শিল্পে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকলেও এ খাতে শ্রমিক বেড়েছে। বাংলাদেশের পেশা খাত তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দুটি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগস্ট শেষে দেশের গড় মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ। একই সময়ে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এখনো দেশর মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মজুরির চিত্রে দেখা যায়, সেখানে সেবা খাতের মজুরি বৃদ্ধি ছিল শীর্ষ পর্যায়ে। বিদায়ী এ অর্থবছরে সেবা খাতের গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কৃষিতে এ সময় গড় মজুরি বেড়েছিল ৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ আর শিল্প খাতের মজুরি ছিল সবচেয়ে কম ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি চলছে। এটি গত দুই বছরের ধারাবাহিক চিত্র। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক দেরিতে হলেও গত অর্থবছর থেকে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছে। ফলে ব্যাংকের তারল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর প্রভাব পড়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষি ও সেবা খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে বিনিয়োগ কমে যায়। কাজ হারাতে থাকেন অনেক শ্রমিক।
একই সময়ে দেশের শিল্প খাতও ধুঁকছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না হওয়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে শিল্প খাতের উৎপাদনে। যদিও জুন শেষে দেশের সেবা ও কৃষি খাতে শ্রমিক কমলেও শিল্প খাতে বেড়েছে বলে উঠে এসেছে চিত্রে।
বিবিএস জানায়, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে মজুরি সূচক ছিল ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ, ২০২২ সালের আগস্টে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মজুরি সূচক ছিল ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
হালনাগাদ প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতে মজুরি বেশি ছিল। এর পরেই সেবা খাতে মজুরির হার ছিল ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে গত আগস্ট মাসে এ খাতে মজুরি কিছুটা বেড়ে ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ছিল। শিল্প খাতে আগস্ট মাসে মজুরি সূচক হয়েছে ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, গত জুলাই মাসে যা ছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। দেশের ৬৪ জেলা থেকে সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আগস্ট মাসের মজুরি সূচক প্রকাশ করে বিবিএস।
দেশে কৃষির সম্ভাবনা অনেক। উৎপাদনও বাড়ছে। বলা হয়, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করছেন, তারাই বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। সরকারি তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অথচ অন্য পেশায় থাকা মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও কম, গড়ে ২০ শতাংশ। এ কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবেও সামনে আসছে কৃষি। কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর এ হতাশার প্রভাব পড়তে পারে পুরো কৃষি খাতে। ফলে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের কৃষকরা উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদন করলেও নিজের জন্য কিছুই রাখেন না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উৎপাদিত ফসল মাঠেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, কৃষক যে খাদ্য ফলান, একটি পর্যায়ে গিয়ে সে খাদ্যই বেশি দামে কিনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক।
এমটিআই