ঢাকা : ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ব্যাংক খাতে।যার পরিমান প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এ ঝুঁকিতে পড়েছে সোয়া লাখ কোটি টাকার বেশি সম্পদ। তবে খেলাপি ঋণের অঙ্ক লুকিয়ে রাখতে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। নিয়মিত হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে আরও পৌণে এক লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৩ সালভিত্তিক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছরের ৯ মাসের চিত্র বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছাবে।
পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। একই সময়ে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো ৭১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। সব মিলিয়ে গত বছরের শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের মোট পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। ২০২৩ শেষে মোট অনাদায়ী ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মোট ঋণের ৩২ দশমিক ১০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।
তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পুনঃতফসিলের নীতি উদার করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সেই উদার নীতির কারণে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু ২০২৩ সালেই ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা এক বছরে এ যাবতকালে সর্বোচ্চ।
গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলছেন, সে সময় পুনঃতফসিল করা ঋণ বর্তমানে পুনরায় খেলাপি হতে শুরু করেছে।
গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে। পরের বছর ২০২০ সালে পুনঃতফসিল কম হয়। ওই বছর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে করা হয় ২৬ হাজার ১১০ কোটি, ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি এবং ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৪৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
গত বছর পুনঃতফসিল ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ি করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গত বছরের শেষ দিকে অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এছাড়া বছর শেষে নিজেদের আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও শেষ প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদার হস্তে নবায়ন করে ব্যাংকগুলো।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আর যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, অন্যথায় প্রার্থী হতে পারেন না।
সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সে সময় বাছবিচার ছাড়াই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। কারণ ২০২২ সালের জুলাইয়ে পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালাও শিথিল করা হয়।
যেমন- ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হয়, আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সুযোগ দেয়া হয়েছে পাঁচ থেকে আট বছর, যা আগে সর্বোচ্চ তিন বছর ছিল। এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না। এছাড়া ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। আর ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় খেলাপি ঋণ নবায়ন বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে ছাড় দেয়াটা ইতিবাচক কিছু বয়ে আনছে না। উল্টো যে ঋণগুলো পুনঃতফসিল মাধ্যমে নিয়মিত করা হচ্ছে, সেই ঋণ পরিশোধে টালবাহানায় আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ ঋণ আবার খেলাপির খাতায় উঠেছে। ২০২২ সালে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি, ২০২১ সালে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৯০ কোটি, ২০২০ সালে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। ২০২৩ সাল শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ২৬ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের উদ্যোক্তারা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এছাড়া পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ চলতি মূলধন, ব্যবসায়িক ১১ শতাংশ, আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :