ঢাকা: দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের তহবিল থেকে তছরুপ হয়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা। কোম্পানিটির বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ও পেটি ক্যাশ থেকে এসব অর্থ তছরুপ করা হয়েছে। আবার জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী লাইফের টাকাতেই সোনালী লাইফের শেয়ারের মালিক হয়েছেন ১০ পরিচালক।
এমন তথ্য উঠে এসেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)’র পরিদর্শন প্রতিবেদনে।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সোনালী লাইফের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করতে অডিট ফার্ম হুদাভাসী চৌধুরী এন্ড কোং-কে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয় বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওই তদন্তে সোনালী লাইফের ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ উঠে আসে। এই প্রেক্ষিতে গত ২১ এপ্রিল থেকে সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ ৬ মাসের জন্য সাসপেন্ড করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। তবে বীমা কোম্পানিটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসককে তদন্ত কাজে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট তারা আইডিআরএ কার্যালয় দিনভর অবরুদ্ধ করে রাখে এবং পরে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে রাত ১টায় দুই শর্তে সমঝোতা হয়।
পরবর্তীতে সমঝোতার শর্ত অনুসারে সোনালী লাইফের প্রশাসক প্রত্যাহার ও পরিচালনা পর্ষদ পুনর্বহালের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং গত ৫ সেপ্টেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে কোম্পানিটিতে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন করে আইডিআরএ।
এরইমধ্যে সোনালী লাইফের তহবিল তছরুপের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইডিআরএ’কে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। এ বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থার অগ্রগতি সম্পর্কেও সংস্থাটিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। বিএফআইইউ’র যুগ্মপরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি গত ২২ সেপ্টেম্বর আইডিআরএ’কে পাঠানো হয়।
সোনালী লাইফের ভাউচার, ইআরপি সফটওয়্যারের তথ্য, ব্যাংকসমূহ, ফাইন্যান্স কোম্পানিসমূহ, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান, সিকিউরিটিজ হাউজ ও গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান (ব্যাংকের মাধ্যমে) থেকে সংগৃহীত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে তহবিল তছরুপ সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ।
বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, সোনালী লাইফের ৩৫৩ কোটি টাকা তছরুপের সাথে জড়িত রয়েছেন কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ ৮ পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী ও অপর দুই কর্মকর্তা। এ ছাড়াও কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহীর এক ভাই ও ফুপুর নাম উঠে এসেছে তহবিল তছরুপে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকায়।
মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস নিয়েছেন ১৮৪ কোটি টাকা: মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস নিয়মবহির্ভতভাবে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে নিয়েছেন ১৮৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভবন বিক্রির নামে নিয়েছেন ১৩৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। বাকী ৪৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা তিনি নিয়েছে নিজের নামে ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে। এই টাকা তিনি নেন ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালে। সোনালী লাইফের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ও পেটিক্যাশ থেকে এসব অর্থ নিয়েছেন বলে বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বিএফআইইউ’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবন বিক্রির নামে ১৩৯.১০ কোটি টাকা নিলেও এই ভবন ক্রয়ের বিষয়ে সোনালী লাইফের বোর্ডসভার কোন অনুমোদন নেই। অনুমোদন নেই বীমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র। এ ছাড়াও ভবনটি ৩৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে যমুনা ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় বন্ধক রাখা।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ভবন বিক্রির নামে নেয়া এই ১৩৯.১০ কোটি টাকা থেকে জনতা ব্যাংকে সিডি এক্রিলিক বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ২৭ কোটি টাকা। আর ড্রাগন সোয়েটারের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। বাকী টাকা তিনি তার মালিকানাধীন যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে- ড্রাগন সোয়েটার্স বাংলাদেশ, ড্রাগন সোয়েটার্স এন্ড স্পিনিং, ড্রাগন ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড কমিউনিকেশনস, সিডি এক্রিলিক বাংলাদেশ এবং ইম্পেরিয়াল সুয়েটার্স বাংলাদেশ।
বিএফআইইউ বলছে, প্রতিবেদনটি প্রস্তুতের সময় মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মতামত নেয়া হয়েছে। মতামতে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস জানিয়েছেন, তিনি ১৩৯.১০ কোটি টাকা তিনি নিয়েছেন ইম্পেরিয়াল ভবনের ভাড়া বাবদ। তবে এর সপক্ষে তিনি কোন দলিলাদি দেখাতে পারেননি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সোনালী লাইফের ইআরপি সফটওয়্যার ও কোম্পানিটির বিভিন্ন ভাউচারের তথ্য অনুসারে ইম্পেরিয়াল ভবনের ভাড়া বাবদ ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৮.১৭ কোটি টাকা নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে বিএফআইইউ। তবে বিএফআইইউ বলছে, পর্যাপ্ত দলিলাদি না পাওয়ায় মোস্তফা গোলাম কুদ্দস ভবনের ভাড়া বাবদ কত টাকা নিয়েছেন তা তারা নিশ্চিত হতে পারেনি।
এএইচ/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :