ঢাকা : সোমবার অফিস শেষ করে কারওয়ানবাজার থেকে বাজার করে বাড়ি ফিরছিলেন সজল মাহমুদ। অন্য বাজার সেরে ডিমের দোকানে এসে হতবাক তিনি।
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের সামনে অন্য দিনগুলোতে অন্তত পাঁচজনকে ডিম বিক্রি করতে দেখা যায়। তবে সোমবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় দেখা গেল একজনকে। তার কাছে আবার মুরগির ডিম ছিল না। ছিল কেবল হাঁসের ডিম।
সজল মাহমুদ ডিম বিক্রেতা মো. নাসিরকে বলছিলেন, ভাই, কোথায় গেলে ডিম পাব?
নাসির বললেন, আমরাই পাই নাই, আপনি আর পাইবেন কই থেইকা?
সজল মাহমুদ বলেন, ডিম নিয়ে কী ঘটতেছে বুঝলাম না। একবার দাম বাড়ে, আবার অভিযান চালানো হয়। আবার কোথাও ডিম পাওয়া যায় না।
ডিমের দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে এবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে এবার পাইকারিতে ডিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ায় খুচরাতেও সংকট তৈরি হয়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিমের ডে ‘ন্যায্য মূল্য’ বেঁধে দিয়েছে, তাতে তাদেরকে যে দরে বিক্রি করতে বলা হয়েছে, সেই দরে তারা কিনতেও পারেন না। কিন্তু এ জন্য তাদেরকে জরিমানা করা হচ্ছে। বেশি দামে কিনে কম দামে বেচার চেয়ে বিক্রি বন্ধ করে রাখাই শ্রেয় মনে করছেন তারা।
কারওয়ানবাজারের খুচরা বিক্রেতা বিক্রেতা মো. নাসির বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডিম বেচে না। দোকানপাট বন্ধ কইরা রাখছে। কয় তাদের নাকি লাভ হয় না।
গত দুই বছর ধরেই ডিমের দাম বাড়তি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ডিমের ‘ন্যায্যমূল্য’ ঠিক করে দেয়।
তারা খামারি পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারিতে ১১ টাকা ১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়।
তেজগাঁওয়ের আড়তে রোববার রাত থেকেই ডিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘ন্যায্য মূল্যে’ তারা ডিম কিনতেও পারেন না। কিন্তু বেশি দরে বিক্রি করলে জরিমানা করা হয়।
তেজগাঁওয়ের আড়তে রোববার রাত থেকেই ডিম বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘ন্যায্য মূল্যে’ তারা ডিম কিনতেও পারেন না। কিন্তু বেশি দরে বিক্রি করলে জরিমানা করা হয়।
কিন্তু কোনো পর্যায়েই এই দরে ডিম পাওয়া যাচ্ছে না। খামার থেকে ডিম কিনে ঢাকায় আনতেই খরচ পড়ে যাচ্ছে সাড়ে ১২ টাকার বেশি, যা বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি।
কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ব্যবসায়ীদের এই বক্তব্য মানছেন না। ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিক ব্যবসায়ীকে লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার তথ্য মিলেছে।
বাজারের এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সন্ধ্যায় কারওয়ানবাজার পরিদর্শনে গিয়ে ডিম সংকট নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আপনি ডিম সাপ্লাই দেখেন না, নাই তো। ডিম আপনার..সাড়ে চার কোটি, পাঁচ কোটি ডিম হয়। এখন থেকে ডিম কি আমি মেশিন দিয়ে তৈরি করব?
তেজগাঁও আড়তে যে চিত্র : সোমবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় ঢাকার তেজগাঁওয়ে গিয়ে ডিমের আড়তগুলো বন্ধ দেখা যায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, রোববার রাত থেকেই বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তারা। সোমবার গাড়ি খামারগুলোতে পাঠানোই হয়নি। পিকআপগুলোকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ‘দুইদিন ডিম বেচাকেনা বন্ধ থাকবে।’
তেজগাঁও ডিম সমিতির সদস্য ও নাসির অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার মো. নাসির বলেন, সরকারি রেট অনুযায়ী আমাদের বিক্রি করতে হবে ১১.১ টাকায়। অথচ খামার থেকেই আমাদের কিনতে হচ্ছে ১২.৫০ টাকায়।
আড়তের পাশে রডের দোকান মেসার্স শফিক এন্টারপ্রাইজের কর্মী মো. শহিদুল বলেন, গতরাত থেকেই তাদের বেচাকেনা বন্ধ দেখতেছি। সাইট (খামার) থেকে নাকি ডিম আনতে গাড়িও পাঠায় নাই।
দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি ট্রাক দেখিয়ে তিনি বললেন, এই ট্রাকগুলো আজও ‘সাইটে’ যায় নাই। ডিমের দাম বেশি হওয়ায় নাকি তাদের পোষায় না শুনলাম।
আড়তের পাশেই ১৫ টির মত পিকআপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
একটি গাড়ির চালক আব্দুল মান্নান বলেন, ডিম সমিতি থেকে বলছে দুইদিন ডিম আনা হবে না। তাই আমরা কেউ যাই নাই।
তেজগাঁওয়ে আড়তে ডিম আনা নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত গাড়িগুলো ধরে অলস বসে আছে। মঙ্গলবারও তাদেরকে খামারে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।
তেজগাঁওয়ে আড়তে ডিম আনা নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত গাড়িগুলো ধরে অলস বসে আছে। মঙ্গলবারও তাদেরকে খামারে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) ডিম আনা হবে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “সমিতি সেটা এখনও জানায় নাই।
ব্যবসায়ীদের এই ‘বেঁকে বসায়’ কারওয়ান বাজারে ডিম কিনতে এসে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে ক্রেতাদের। কারণ এই আড়ত থেকেই ডিম কিনে নিয়ে খুচরায় বিক্রি করেন তারা।
কাপ্তানবাজারের কী চিত্র?
ঢাকায় মুরগি ও ডিমের সবচেয়ে পুরনো পাইকারি আড়ত কাপ্তানবাজারে অবশ্য পাইকারিতে ডিম পাওয়া যাচ্ছে।
সোমবার সন্ধ্যায় এই বাজারের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ বলেন, আমাদের এখানে ডিমের বাজার এখনও স্বাভাবিক আছে।
তবে ‘ন্যায্য মূল্যে’ ডিম পাওয়া যাচ্ছে না এই বাজারেও।
মাসুদ বলেন, গতকাল পরিবহনসহ আমাদের কেনা পড়ছে ১২ টাকা ৫৫ পয়সা। আর বিক্রি ১২ টাকা ৮০ পয়সা। তবে আগামীকাল লোকসান হবে। আজ পরিবহনসহ আমাদের কেনা পড়তেছে ১৩ টাকা। কিন্তু আমার বিক্রি করতে হবে ১২ টাকা ৯০ পয়সা দরে। প্রতি ডিমে ১০ পয়সা করে লস দিতে হবে।”
‘আমরা বেশি দামে কিনে কম দামে তো বিক্রি করতে পারব না’
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী আড়তে সোমবার থেকে ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার কথা জানান আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর শুক্কুর।
ডিম প্রতি ২০ থেকে ৩০ পয়সা লাভ করার কথা জানিয়ে তিনি জানান এদিন বাজারে দর ছিল ১২ টাকা ৮০ পয়সা করে।
কিন্তু সে দামে ডিম বিক্রি করায় আমাদের এক ব্যবসায়ীকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবারও একজনকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আমরা বেশি দামে কিনে কম দামে তো বিক্রি করতে পারব না।
শুক্কুরের ভাষ্য, সোমবার মোকামে যে দর, তাতে তাদেরকে মঙ্গলবার বিক্রি করতে হবে ১৩টাকা ৩০ পয়সা দরে।
ঢাকার তেজগাঁওয়ের মত চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতেও ডিমের আড়তগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার তেজগাঁওয়ের মত চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতেও ডিমের আড়তগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে বৃহৎ ডিমের বাজার নগরীর পাহাড়তলী এলাকায়। সেখান থেকে চট্টগ্রাম নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ডিম নিয়ে বিক্রি করা হয়। দিনে সেখানে বিক্রি হয় ২২ থেকে ২৫ লাখ ডিম। যেগুলো চট্টগ্রাম শহরসহ পুরো জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়।
চট্টগ্রামে খুচরা বাজারে সোমবার ১০০টি ডিম বিক্রি হচ্ছিল এক হাজার ৪০০ টাকায়। আর একটি বা দুটি নিলে দাম পড়ছে ১৫ টাকা করে।
তবে ব্যবসায়ীদের এই বক্তব্যকে পাত্তা দিচ্ছেন না জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফয়েজ উল্যাহ। তিনি বলেন, আমরাও বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি তারা ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। আমরা যদি তাদের বেআইনিভাবে ব্যবসা করতে দেই, তাহলে তো তারা আইনের তোয়াক্কা করবে না।
আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শুক্কুর বলেন, তারা আমাদের বলে ম্যামো (ক্রয় রসিদ) সাথে রাখার জন্য। কিন্তু মোকাম থেকে তো আমাদের কোনো ম্যামো দেয় না। যার কারণে আমরাও ম্যামো রাখতে পারি না। সূত্র : বিডিনিউজ
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :