ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে তৃতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১৭টি ব্যাংকের নিট মুনাফা বেড়েছে। এ সময়ে মুনাফা কমেছে ১০টি ব্যাংকের। তবে লোকসান হয়েছে চরম সংকটে থাকা ৯টি ব্যাংকের।
ব্যাংকগুলোর তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের জুলাই মাস জুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আগস্টের ৫ তারিখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তারপর আগস্ট-সেপ্টেম্বর জুড়ে দেশে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে। বিগত সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে খাদের কিনারে ফেলে দেওয়ার চিত্রও এ সময়েই উন্মোচিত হয়। এতে গ্রাহকরা আস্থা হারিয়ে ব্যাংক ছাড়তে শুরু করেন। এরপরও তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা বৃদ্ধি পুরো ব্যাংক খাতের জন্য ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, গ্রাহক যদি ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখতে না পারেন তাহলে লোকসান অবধারিত। মূলত গ্রাহকের আস্থার ওপর নির্ভর করে ব্যাংকের ব্যবসা হয়। গ্রাহকের আস্থা থাকলে আমানত বাড়বে এবং ব্যাংক ভালো ব্যবসা করবে—এটাই স্বাভাবিক। না থাকলে সেই ব্যাংক কখনোই ভালো ব্যবসা করতে পারবে না।
ব্যাংকগুলোর আয় বাড়ার কারণ হিসেবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, তৃতীয় প্রান্তিকজুড়ে দেশ অশান্ত থাকলেও ব্যাংকগুলোর সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ, বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে আয় এবং সুদহারের সীমা প্রত্যাহারে মুনাফা বেড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, গ্রাহকরা যেসব ব্যাংকে আস্থা রেখেছে সেসব ব্যাংকই মুনাফা করতে পেরেছে। অন্যরা লোকসান করেছে।
মুনাফা বৃদ্ধি পাওয়া ১৭ ব্যাংক: ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৃতীয় প্রান্তিকে সর্বোচ্চ মুনাফা বেড়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের। এই ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা বেড়েছে ৪২৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। এরপরেই রয়েছে পূবালী ব্যাংক। এই ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ১১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
মুনাফা বৃদ্ধি পাওয়া অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, এসবিএসি ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর অনিরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদক অনুসারে, ব্র্যাক ব্যাংক ১ হাজার ১০ কোটি ৬২ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ৪২৯ কোটি ২১ লাখ টাকা বা ৭৪ শতাংশ।
পূবালী ব্যাংক ৪৪৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৩৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ১১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বা ৩৩ শতাংশ।
এনসিসি ব্যাংক চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ২০১ কোটি ৫১ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ১০৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বা ১০৮ শতাংশ।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে ৬৫ কোটি টাকা বা ১৫ শতাংশ। সিটি ব্যাংক ২০১ কোটি ২৩ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৪২ কোটি ৫ লাখ টাকা। উত্তরা ব্যাংক ১২১ কোটি ৮১ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছর ছিল ৭৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ওয়ান ব্যাংক চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ৫৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে। এ ছাড়াও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১১৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
যমুনা ব্যাংক চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এসবিএসি ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে ২৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা বা ১৫৫ শতাংশ। ইউসিবি ব্যাংক ৯৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বা ৩০ শতাংশ বেশি। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ হিসেবে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ২১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বা ২২ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ৯০ কোটি ১১ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা বা ৯ শতাংশ। ট্রাস্ট ব্যাংক ১২৩ কোটি ৪ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা বা ৪ শতাংশ। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বা ১৬ শতাংশ। এনআরবিসি ব্যাংক ১১ কোটি ২৪ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬ কোটি ৭১ অর্থাৎ ব্যাংকটি লোকসান থেকে মুনাফায় ফিরেছে। প্রাইম ব্যাংক তৃতীয় প্রান্তিকে নিট মুনাফা করেছে ৫১০ কোটি টাকা।
মুনাফা কমা ১০ ব্যাংক: আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচ্য সময়ে আইএফআইসি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এবি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা কমেছে।
লোকসান করা ৯ ব্যাংক: তৃতীয় প্রান্তিকে লোকসান গুনতে হয়েছে ৯ ব্যাংকের। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া।
এএইচ/আইএ