Menu
ঢাকা: দেশের শিল্প গ্রুপ মেঘনা গ্রুপের ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বীমা করতে ১৩৭২ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স।
কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে গত ১০ বছর ধরে। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে তদন্ত শেষের আগেই মাঝ পথে থেমে যায় তদন্ত কার্যক্রম।
রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ আত্মসাতের যে অভিযোগ: মেঘনা গ্রুপের ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বীমা করে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি এবং আত্মসাতের এই অভিযোগ করেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক এম এফ কামাল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর দফায় দফায় তিনি এই অভিযোগ করেন।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে এমএফ কামাল অভিযোগ করেন ২০১৪ সালে। সর্বশেষ তিনি অভিযোগ করেন ২০১৯ সালে। এই অভিযোগে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স রাজস্ব ফাঁকি এবং অর্থ আত্মসাৎ করেছে ১৩৭২ কোটি টাকা। প্রিমিয়ামে টাকা ও আমদানি মূল্য কম দেখিয়ে কোম্পানিটি এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর আগে ২০১৪ সালের অভিযোগে তিনি দাবি করেছিলেন কোম্পানিটির রাজস্ব ফাঁকি ও আত্মসাতের পরিমাণ ৪৭২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে তদন্ত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে এনবিআর ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ২৫ মার্চ ২০১৯ সালে। অপরদিকে আইডিআরএ কমিটি গঠন করে ১২ জানুয়ারি ২০২১ সালে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তদন্ত করতে ২ জানুয়ারি ২০১৮ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আইডিআরএ’র কাছে একটি চিঠি পাঠায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব মো. সাইদ কুতুব স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের স্বঘোষিত চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান অপসারণসহ মূল উদ্যোক্তাদের কোম্পানিতে পুনর্বহাল এবং আত্মসাতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ এবং আত্মসাৎকৃত টাকা আদায়ের লক্ষে একজন প্রশাসক নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়। সেই সাথে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
পরে ১৮ এপ্রিল ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনালের ১৩৭২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে আইডিআরএ’কে চিঠি দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব ইফতেখার হোসেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই বছর পর ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ৪ সদস্যের একটি কমটি গঠন করে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। চার সদস্যের ওই কমিটির প্রধান করা হয় সংস্থাটির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক (আইন) এস এম শাকিল আখতারকে।
এ ছাড়াও তৎকালীন পরিচালক (নন-লাইফ) মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক (আইন) মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম ও অফিসার মো: রশিদুল হাবিবকে সদস্য করা হয় কমিটিতে। কমিটি ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে। একইসাথে ১০ ফেব্রুয়ারি অভিযোগকারী উদ্যোক্তা পরিচালক এমএফ কামালকে অভিযোগের স্বপক্ষে নথিপত্রসহ প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়।
তদন্ত সংক্রান্ত নথিপত্র অনুসারে, এমএফ কামাল ১৮ ফেব্রুয়ায়ি ২০২১ তারিখে তদন্ত দলের কাছে স্বশরীরে হাজির হয়ে তদন্ত দলকে কিছু প্রয়োজনীয় নথিপত্র দাখিল করেন।
এনবিআর’কে গোয়েন্দা সংস্থার চিঠি, তদন্তের জন্য ৫ সুপারিশ:
২০২৪ সালের জুন মাসে ভূয়া বা জাল ইন্স্যুরেন্স কভার নোট ইস্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল কর্তৃক উক্ত বীমা কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেয়। চিঠিতে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ৫টি খাতে তদন্তের সুপারিশ করে সংস্থাটি।
গোয়েন্দা সংস্থার ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ২০ বছরের ৫টি খাতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের আত্মসাতের পরিমাণ ১৫১৮ কোটি টাকা।
এই অভিযোগের তদন্ত করতে সংস্থাটি যে ৫টি বিষয়ে তদন্তের সুপারিশ করে সেগুলো হলো- মেঘনা গ্রুপের ৭০টি কোম্পানির বিপরীতে বছর ভিত্তিক ও শ্রেণী ভিত্তিক দাবিকৃত ও পরিশোধিত দাবির পরিমাণ যাচাই, ইস্যুকৃত কভার নোট পলিসির সংখ্যা এবং প্রিমিয়াম এবং আদায়কৃত প্রিমিয়ামের পরিমাণ, পলিসি ইস্যু করার পর কি পরিমাণ পলিসি ও প্রিমিয়াম বাতিল করা হয়েছে তার পরিমাণ, ৭০টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কি পরিমাণ টাকা বীমা দাবি বাবদ পুনর্বীমা কোম্পানি সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বিদেশী পুনর্বীমা কোম্পানি থেকে আদায় করা হয়েছে তার পরিমাণ ও বীমা দাবির পরিশোধের ব্যাংক হিসাব।
যে প্রক্রিয়ায় তদন্তের কথা বলেছিল আইডিআরএ’র তদন্ত দল:
আইডিআরএ’র তদন্ত কমিটি ২৪ জানুয়ারি ২০২১ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শ করে। এই পরিদর্শনের সময় বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স তদন্ত কমিটির চাহিদা অনুসারে নথিপত্র সংগ্রহ করে।
এর মধ্যে রয়েছে- অভিযোগকারি এমএফ কামালের উদ্যোক্তা পরিচালক পদ থেকে অব্যহতির সংক্রান্ত দলিলাদি, রাইট শেয়ার সংক্রান্ত দলিলাদি, আয়কর কর্তৃপক্ষ, দুদক, নিরীক্ষা গোয়েন্দা অধিদফতরের হালনাগাদ নিরীক্ষা প্রতিবেদন, ৩ বছরের ভ্যাট রিটার্ন ও চালান, শেয়ার হোল্ডার কর্তৃক প্রত্যেক বছরের লভ্যাংশ নিয়মিত গ্রহণের দলিলাদি, তৎকালীন বীমা অধিদফতর কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের প্রতিবেদন, পূর্বে অভিযোগের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত কাগজপত্র।
এসব কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ আত্মসাতের এই তদন্তের প্রক্রিয়া এবং যেসব নথিপত্র প্রয়োজন সে বিষয়ে একটি মতামত তুলে ধরে।
অভিযোগ অনুসারে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৬ সালে মেঘনা গ্রুপের ৭০টি কোম্পানির ৫৭ হাজার ৫০৭ কোটি টাকার মালামাল আমাদানি করেছেন। কিন্তু আন্ডার ইনভয়েস করে তা আমদানিকৃত মালামালের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৩২ কোটি ২৭ লাখ ৬৩ হাজার ৩৯৬ টাকা।
তদন্ত দলের মতে, এই অভিযোগ তদন্তের জন্য ২০০০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মেঘনা গ্রুপের ৭০টি প্রতিষ্ঠানে কত টাকার পণ্য আমদানী করা হয়েছে তা যাচাইয়ের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে পত্র প্রেরণ করে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করতে হবে।
এর পাশাপাশি উক্ত আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স থেকে কভার নোট ইস্যু করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। সেই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টে পত্র দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
অভিযোগ অনুসারে, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ৭০টি প্রতিষ্ঠানের ৫০০ মোটর গাড়ি রয়েছে। এসব মোটর গাড়ির বীমা করা হয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সে। তবে ৫০০টি মোটরের বীমা বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সে করা হলে মোটর বীমা গুলোর বিপরীতে কোনো প্রিমিয়াম জমা করা হয়নি।
তদন্ত দল মনে করে, এই অভিযোগ যাচাই বা তদন্ত করতে হলে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের নামে প্রিমিয়াম জমা নেয়ার ব্যাংক হিসাবগুলোর তথ্য জানতে বিভিন্ন ব্যাংকে পত্র প্রেরণ করে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করা ও তা যাচাই-বাছাই করা।
তদন্ত দলের মতে, অভিযোগ অনুসারে মেঘনা গ্রুপের ৭০টি প্রতিষ্ঠানের নামে কি পরিমাণ পলিসি ইস্যু করা হয়েছে তা যাচাই করতে হলে প্রত্যেকটি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে চিঠি প্রদান করে জানতে হবে ৭০টি প্রতিষ্ঠানের নামে কি পরিমাণ ঋণ রয়েছে, নতুন ঋণ বা নবায়নকৃত ঋণের বিপরীতে কি পরিমাণ পলিসি ইস্যু করা হয়েছে, প্রিমিয়ামের পরিমাণ কত এবং তা বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। তবে এসব কর্মকাণ্ডের কোনটির-ই উদ্যোগ নেয়নি আইডিআরএ গঠিত তদন্ত দল।
যা বলছে এনবিআর ও আইডিআরএ: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)’র চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং এ বিষয়ে তদন্তের জন্য গোয়েন্টা সংস্থা থেকে চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। একইসঙ্গে সেখান থেকে জানানো হয়, বিষয়টি তদন্তের জন্য বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব (কাস্টমস: গোয়েন্দা)’র দপ্তরে পাঠানো হয়েছে গত ২৩ জুন ২০২৪ তারিখে। তারা বিয়ষটি দেখছে।
এআর
© 2025 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | সোনালীনিউজ.কম
Powered By: Sonali IT