Menu
ঢাকা: তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে অনেক কারখানা। উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে বা স্থগিত রয়েছে। চালু থাকা কারখানাগুলোও চাহিদামতো চাপে গ্যাস না পেয়ে বহুমাত্রিক সমস্যায় ভুগছে। শিল্পমালিকরা বলছেন, সময়মতো পণ্য দিতে না পারায় বাতিল হচ্ছে ক্রয়াদেশ। পণ্য না পেয়ে অনেক গ্রাহক চলে যাচ্ছেন অন্য জায়গায়।
দেশে গত দুই বছরের মধ্যে বর্তমানে আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ তুলনামূলক বেশি হলেও স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন ক্রমে কমে যাওয়ায় শিল্পে জ্বালানি সংকট দূর হচ্ছে না।
শিল্পমালিকরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও সুরাহ হচ্ছে না ব্যবসায়ীদের গ্যাস সংকট সমস্যার। শিল্পকারখানায় গ্যাস সংকট নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ মিলছে না। বেশ কিছুদিন ধরে এ সংকট তীব্র হয়ে পড়েছে কারখানাগুলোতে। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন। শতভাগ গ্যাস না পাওয়ায় এখন বিকল্প উপায়ে কারখানায় উৎপাদন চালু রাখতে হচ্ছে বলে জানান তারা। এর ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে দৈনিক ৪১০ থেকে ৪২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা মোতাবেক গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না এক দশকের বেশি সময় ধরে। তবে ৩৫০-৩৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা গেলে পরিস্থিতি মোটামুটি সামলে নেওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ২৭০ কোটি ঘনফুট বিতরণ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ গত বুধবার ২৮২ কোটি ১০ লাখ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এ দিন প্রায় সাড়ে ৯৮ কোটি ঘনফুট পরিমাণ গ্যাস এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হয়।
পেট্রোবাংলা এবং তিতাস গ্যাস কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা জানান, আর্থিক ও প্রকৌশলগত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক ২০০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস উৎপাদন সম্ভব নয়। কক্সবাজারে থাকা ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকেও দৈনিক ১০৮ কোটি ঘনফুটের বেশি এলএনজি সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব।
এদিকে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমও অনেক বছর ধরে ধীর, মন্থর। বাস্তবতা হলো দৈনিক ৪১০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসও গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। গ্যাস সরবরাহে এই প্রকট ঘাটতির মধ্যে অবৈধ সংযোগ ও সরবরাহ আরেকটি ট্রাজিক ব্যাপার হয়ে আছে। এমন প্রেক্ষপটে দেশীয় সার, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, নিট, ইস্পাত এবং সিমেন্ট কারখানায় সার্বিক সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকে নেমেছে উৎপাদন। কারখানা তৈরি করেও আমদানি নির্ভর হয়ে আছে সারের জোগান। ছোট এবং মাঝারি শিল্পও ধুঁকছে একই সমস্যায়।
এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে এসেছে-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব। শিল্পে আরো ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বর্তমানে শিল্পকারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। নতুন শিল্পের জন্য এটি বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুনানিতে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে পেট্রোবাংলা জানায়, প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানিমূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। ফলে এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের দামের মধ্যে দূরত্ব কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। তবে পেট্রোবাংলার প্রস্তাবনাকে অযৌক্তিক দাবি করে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি না করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, শিল্প কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার শিল্পকারখানা থেমে থেমে চলছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। ফলে একদিকে সুযোগ নষ্ট এবং অন্যদিকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত 'দেশের শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট সমাধানের পথ' শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন জানান, জ্বালানি সংকটে সিরামিক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। পোশাক খাতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। স্টিল কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
গ্যাস সংকট নিয়ে প্যাসিফিক ডেনিমসের কোম্পানি সচিব মুহাম্মদ ছোরহাব আলী সোনালী নিউজকে বলেন, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও আমরা কারখানার গ্যাস সংকটের কোন পরিবর্তন পাইনি। কখনো আমরা গ্যাসের চাপ একভাবে পাই না বা ফুল চাপ পাওয়া যায় না। যার কারণে অনেক সময় প্রচুর কাচামালের অপচয় হয়। হঠাৎ হঠাৎ গ্যাসের চাপ কমে যাওয়া মানে চলমান লটের অধিকাংশ সুতা নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমাদের জায়গা থেকে যথেষ্ট চেষ্টা করেছি কর্তৃপক্ষকে বুঝানোর কিন্তু কোন সমাধান আসেনি। অল্প গ্যাসের চাপে কোন রকমভাবে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। সিজনে ফুল সাপোর্ট না পেলে ব্যবসার অবস্থা যা হওয়ার আমাদের অবস্থা তাই হয়েছে। কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোম্পানিটির জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ ইউনুস আলী সোনালী নিউজকে বলেন, দুই বছর আমরা নিয়মিত গ্যাস পেয়েছি কিন্তু গত এক বছর ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছি না। ১ ঘণ্টা থাকলে ৫ ঘণ্টা থাকে না। আমাদের ২৪ ঘণ্টা মেশিন চলে কিন্তু এখন ঠিক মতো ৮ ঘণ্টা চালাতে হিমসিম খাচ্ছি। গ্যাসের চাপ কমে গেলে অনেক সুতা এবং কাপড় নষ্ট হয় তার ফলে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্যাস কর্তৃপক্ষকে বলেও কোন সমাধান পাচ্ছি না। তারা বলে গ্যাস নেই কোথা থেকে দিব। এভাবে চলতে থাকলে বায়ারদের সাথে ডিল রাখা কঠিন হয়ে যাবে। তারা আমাদের জন্য বসে থাকবে না।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সোনালী নিউজকে বলেন, আমাদের দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে আমরা ভালোই গ্যাস পেতাম কিন্তু দাম বাড়ানোর পর দিনে বলেন আর রাতে, কোনো সময়েই ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছি না। এতে সব মেশিন চালানো যাচ্ছে না। গ্যাস-সংকটের কারণে সুতা ও কাপড় ডাইংয়ের কাজ ব্যাহত হওয়ায় কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় আসছে না। এতে প্রতিটি ক্রয়াদেশের বিপরীতে সরবরাহ বিলম্বিত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো গ্যাস, দ্বিতীয় এনবিআর এবং তৃতীয় হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এতো কিছুর মধ্যে আমাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গ্যাস চাহিদার আলোকে তো পাচ্ছিই না, আর পাবো কিভাবে আমাদের দেশে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে কি পর্যাপ্ত গ্যাস কূপ খনন হচ্ছে?
তিনি বলেন, সরকার দিন দিন আমাদের সুবিধাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে কিন্তু তার বিপরীতে কোনো উপায় বের করছে না। এজন্য আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। কারণ বায়াররা যে রেট দেয় তার সাথে আমাদের খরচ মিলছে না। আবার আমরা যে দাম দেই তা বায়ারদের পছন্দমত হচ্ছে না। বিদেশি অনেক বায়ারের ক্রয়াদেশ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো আছে তা শেষ হলে একদম খালি হয়ে যাবে ক্রয়াদেশ। এতে করে শুধু আমরাই না দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দেশে গ্যাসের সংকট নতুন কোনো বিষয় নয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস-সংকটে ভুগছে শিল্প খাত। এই সংকট দেখিয়েই সরকার গ্যাস আমদানির পথে হেঁটেছিল। ২০১৮ সালের শেষ দিকে দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি শুরু হয়।
কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সরকার চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দেয়। এখন অবশ্য এলএনজির দাম অনেক কমে গেছে।
গ্যাসের স্থানীয় উৎপাদন না বাড়ায় গ্যাস খাত এরই মধ্যে বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে। এলএনজি আমদানি করে তা গ্যাসে রূপান্তরের মাধ্যমে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে একটি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে।
এএইচ/আইএ
© 2025 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | সোনালীনিউজ.কম
Powered By: Sonali IT