ঢাকা : শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে শুরু থেকেই কিছু প্রশ্ন আছে। আবার শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগ কেমন হবে, কী উদ্দেশ্যে কোথায় হবে তা নিয়েও তর্ক রয়েছে। তারপরও একটি বিষয়ে মোটামুটি স্থির হওয়া গেছে যে, বর্তমান সময়ের এই ছুটে চলা বিশ্বে এখনো শিক্ষা বিষয়েই রয়েছে উন্নতির বড় সুযোগ। এই একটি মাত্র ক্ষেত্রেই রয়েছে যথাযথ প্রতিযোগিতা। যে প্রতিযোগিতায় বিজয়ের মধ্য দিয়েই অন্যের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ আছে। যদিও ছড়ি ঘোরানো শব্দটি কানে বাজে, রুচিহীন বলেও মনে হতে পারে। তারপরও শব্দটি ব্যবহারের পেছনে রয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়টিকে স্পষ্ট করা। বর্তমান সময়ে রাজ্য দখলের মাধ্যমে অন্যকে জয় করে না কেউ। বর্তমান সময়ে জ্ঞান, বিজ্ঞানে যারা এগিয়ে তারাই অন্য জাতি বা রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। প্রভুত্ব বজায় রাখে। ব্যবসা-বাণিজ্যও তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। আর এ শুধু শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমেই করা সম্ভব।
মানুষ ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে প্রযুক্তির ওপর। প্রযুক্তির সুবিধা নিতে নিতে মানুষ এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে প্রযুক্তির সুবিধা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হলেও সে অচল, অস্থির হয়ে ওঠে। বাঁচার জন্য মানুষকে খাবার গ্রহণ করতে হয়। এই খাবার উৎপাদনের সকল উপাদানই এখন প্রযুক্তির সহায়তায় চলে যাচ্ছে অন্যের হাতে। এক সময় যে কৃষক শস্য উৎপাদন করত, ফসল ফলাত, আজো সে-ই ফসল ফলায়, শস্য উৎপাদন করে। কিন্তু এই ফসল ফলানোর সবটুকু কৃতিত্ব তো দূরের কথা, কোনো কৃতিত্বই আর কৃষক পান না। কারণ, কৃষককে ফসল ফলাতে হলে বীজ, কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয়। যার কোনোটাই তার সাধ্যের মধ্যে নেই। তারও চেয়ে বড়, কৃষকের হাতে ফসল ফলানোর বীজও নেই। তাও চলে গেছে, চলে যাচ্ছে অন্যের হাতে। কৃষক শুধু ক্রীড়নক। দায়িত্ব পালন করে পেটে-ভাতে বেঁচে থাকা। প্রসঙ্গ ঘুরে যাচ্ছে, তাই ফিরে আসছি মূল প্রসঙ্গে। শিক্ষার নানা সমস্যা মেনে নিয়েই শিক্ষা তথা জ্ঞানার্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে ছন্দপতন ঘটিয়েছে কোভিড-১৯।
গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ থেকেই শুরু হয় পৃথিবীর থমকে যাওয়া। সবকিছু বন্ধ হতে থাকা। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে দেখা মেলা নোভেল করোনা বা কোডিভ-১৯ নামে পরিচিত ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। লকডাউন, আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা উপায় বের করা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাাসকে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। প্রায় প্রতিটি দেশেই সে তার অস্তিত্ব জানান দেয়। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় ভাইরাসটি। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা করমর্দনের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ায়। প্রতিষেধক যেহেতু আবিষ্কৃত হয়নি, তাই ভাইরাস মোকাবিলায় শারীরিক দূরত্ব মেনে চলাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ জন্যই দেশে দেশে সরকার লকডাউন জারি করে। এক দেশে থেকে আরেক দেশে তো বটেই, এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ স্বেচ্ছাবন্দিত্ব মেনে নেয়। প্রাণ বাঁচাতে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে মানুষ ঘরকেই আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। করোনার প্রকোপ তবুও কমানো সম্ভব হয়নি অনেক দেশেই। আমরা পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও, শঙ্কা ছিল অনেক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মোকাবিলা করা কঠিন হতো। উন্নত দেশগুলো যেখানে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে আমাদের অবস্থা কি হতো তা সহজেই অনুমেয়। আর তাই সরকারের ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের নিরাপদ রাখতে সহায়তা করেছে।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। মার্চেই করোনা সংক্রমণে একজনের মৃত্যু হয়। দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ভাইরাস। মানুষের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার শুরুতেই বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিশু-কিশোর, তরুণরা যেন নিরাপদ থাকে, তাদের ঘিরে যে পারিবারিক চক্র, তারা যেন নিরাপদ থাকে, সে উদ্দেশ্য থেকেই সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ। পরবর্তীতে মার্চের শেষ সপ্তাহে ভাইরাসের লাগামছাড়া গতি দেখে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এতে মানুষের পক্ষে ঘরে আশ্রয় নেওয়া সুবিধা হয়। ভাইরাসের প্রকোপ থেকে নিরাপদ থাকা সুবিধা হয়। মানুষের নিরাপত্তায় সরকারের আন্তরিকতা এবং ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশংসা পায়। করোনার প্রকোপ কতদিন থাকবে, তা কেউ জানে না। করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। সামাজিক দূরত্ব মেনে এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে করোনাকে হাতের মুঠোয় রাখা গেলেও আমরা কেউই বিপদমুক্ত নই। কারণ করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হবার মতো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত আজ অবধি হয়নি। তবে দেশে দেশে গবেষণা হচ্ছে, চেষ্টা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা টিকা আবিষ্কার করলেও, তার শতভাগ সফলতা নিশ্চিত হয়নি, মানবশরীরে তার প্রয়োগে পুরো সাফল্যের সন্ধান মেলেনি। যতদিন করোনার প্রতিষেধক না আসবে, ততদিন বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়।
এ ধরনের আশঙ্কা থেকেই শিশু, কিশোর, তরুণদের নিরাপদ রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল, সেখানে এখনো স্থির। তাই অচল পৃথিবী সচল হতে শুরু করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল হয়নি। করোনাকালীন সময়ের এই দীর্ঘপথ ঘরে বসে শিক্ষার্থীরা। তাদের স্বাভাবিক জীবনেও ছন্দপতন হয়েছে। টানা ঘরবন্দিত্বের কারণে নানারকম মানসিক অস্থিরতাও দেখা দিচ্ছে অনেকের। শিক্ষার স্বাভাবিক গতি না থাকাতেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে ধারাবাহিকতা ও আগ্রহ। করোনা কতদিন থাকবে, কবে মুক্তি মিলবে, কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে মানুষ, তা অনিশ্চিত জেনেই, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন কার্যক্রমে উৎসাহ দেয়। সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। অনলাইন ক্লাস চালু থাকলেও পরীক্ষা বিষয়ে সরকার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিছু সিদ্ধান্ত কার্যকরও করেছে। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না নিয়ে, শিক্ষার্থীদের অটো প্রমোশন দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অটোপ্রমোশন পেয়ে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা।
সরকারের এই নির্দেশনার পরও কিছু কিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনেই পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। অর্ধবার্ষিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষা গ্রহণের কাজটিও তারা সম্পন্ন করে। তবে এটা শুধু অভিভাবকদের কাছ থেকে পয়সা হাতিয়ে নেবার জন্য, এমন অভিযোগও কিন্তু বিস্তর। যদিও সেই প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়েছে, সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্তের ফলে।
এখন নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে উচ্চশিক্ষা স্তরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষাকার্যক্রমও বন্ধ। পাবলিক এবং বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেও (ইউজিসি) সিদ্ধান্ত মোতাবেক অনলাইন ক্লাস চালু আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা হচ্ছে না, ফলে ক্লাস হলেও শিক্ষার্থীরা থেকে যাচ্ছে একই শিক্ষাবর্ষে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইনে পরীক্ষাও নিচ্ছে। এতে সেই শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী সেমিস্টারে উত্তীর্ণ হচ্ছে। এমনিতেই আমদের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে সেশনজট। ফলে একই উচ্চমাধ্যমিক পাস করে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যেও স্বাভাবিক সময়ে তৈরি হয় ব্যবধান। কারণ সেশনজটের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যখন আটকে আছে, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার আগেই পাস করে চাকরির বাজারে নিজের অবস্থান ঘোষণা করছে। কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিচ্ছে। এ অবস্থায়, অনলাইনের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আরো এগিয়ে যাওয়ায় বৈষম্য বাড়ছে। যদিও অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষার মান নিয়েও রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন এবং অভিযোগ। তারপরও এভাবে দ্বিমুখী সিদ্ধান্তের কবলে পড়ে কোনো শিক্ষার্থীর সামনে থেকে সময় ও সুযোগ হারিয়ে যাক, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ভর্তি হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আমরা যদি মেধাবীদের বড় অংশের বিষয়ে এখনো সচেতন না হই, তবে তা সমস্যা বাড়াবে বই কমাবে না। এক্ষেত্রে আগামীতে শ্রমবাজারেও বড় ঘাটতি তৈরি হবে। সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে বয়স একটি বড় ভূমিকা পালন করে। আমরা যদি সে বিষয়টিও মাথায় রাখি, তাহলেও পাবলিক এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়া ও না নেওয়ার যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তার যথাযথ সমাধান বের করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের যে ধারা তা বাড়তে থাকবে এবং এতে নতুন সংকট তৈরি হবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক