ঢাকা : আগে শিক্ষক ও পরে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। শিক্ষকদের টিকা দিতে বয়সসীমা শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে ৪০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী শিক্ষকরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকা নিতে পারলেও এখন থেকে ৪০ বছরের কম বয়সী শিক্ষকরাও টিকা নিতে পারবেন।
এ জন্য টিকা নিবন্ধনের সুরক্ষা অ্যাপে শিক্ষকদের অগ্রাধিকারের তালিকার শীর্ষে আনা হয়েছে। সেখানে ‘শিক্ষক’ নামে নতুন ক্যাটাগরি করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য সুরক্ষা অ্যাপে এখনো কোনো ক্যাটাগরি করা হয়নি।
ইতিমধ্যেই ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সরকারি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ওই তালিকায় সরকারি কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানের মোট ৯ লাখ ৯৭ হাজার ৩১৫ জন শিক্ষক ও ২৬ লাখ ৮৫ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৬, প্রফেশনাল শিক্ষার্থী ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩, মাদ্রাসা (ফাজিল-কামিল) ৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৯৭, টেকনিক্যাল (নন-ভোকেশনাল) ৬ লাখ ৯ হাজার জন রয়েছেন। অবশিষ্ট ৬০ হাজার ২০০ জন কোন ক্যাটাগরির শিক্ষার্থী তা জানা যায়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এই তালিকা সম্পূর্ণ নয় বলে ওই মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তারা দু-চার দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ তালিকা পাঠাবেন। সেই তালিকা পেলেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তারপরও এসব শিক্ষক ও শিক্ষার্থী টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন।
শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চাই।
তবে তার আগে আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী যাদের বয়স হয়েছে, এমন শিক্ষার্থীদেরও করোনার টিকা দিতে চাই। তিনি আরও বলেন, উচ্চশিক্ষা স্তরে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে করোনার টিকা দেওয়া হবে। নিম্নস্তরেও আমরা শিক্ষকদের টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করতে চাচ্ছি। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বয়সের নিয়ম অনুযায়ী অন্যদের টিকা দেবে। আমরা আরও টিকার অর্ডার দিয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চাই। এ কারণে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি।
এরপর ওই দিন সন্ধ্যায় এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
তিনি জানান, ৩০ মার্চ দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। এর আগে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিবেশ পর্যালোচনা করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একই দিন শিক্ষামন্ত্রী জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হবে ঈদের পর ২৪ মে থেকে।
সে ক্ষেত্রে কবে নাগাদ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন ও টিকা দেওয়া শুরু হতে পারে, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, পুরো তালিকা না পেলে শুরু করা যাবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় যত দ্রুত তালিকা দেবে, তত দ্রুত শুরু করা যাবে। কারণ তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিবন্ধন করতে পারবেন। নিবন্ধন না করলে তো টিকা দেওয়া সম্ভব নয়। নিবন্ধন করতেই হবে। ২৬ মে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে ও ১৭ মে হল খুলবে। আর ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ খুলবে। সে তারিখ অনুযায়ী আমরা টিকার পরিকল্পনা করছি।
অবশ্য দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিস্থিতি অনেক আগেই পার হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন।
তিনি রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি)বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। সংক্রমণ শনাক্তের হার ৫ শতাংশ যদি পরপর দুই সপ্তাহ টিকে থাকে, তারপর খুলে দেওয়া যায়। অথচ এই হার বাংলাদেশে এক মাসের বেশি হয়ে গেছে। সুতরাং এখন ধাপে ধাপে খোলা যায়। তবে সবগুলো একসঙ্গে খোলার দরকার নেই। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে আবাসিক সুবিধা আছে, সেগুলো দু-একটা খুলুক। সেখানে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়, সেটা দেখে ধাপে ধাপে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে শুধু চিকিৎসকদের দিয়ে হবে না, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ তৈরি করতে হবে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা থাকবেন। তারা প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারটা নিশ্চিত করবেন। তারা মনিটরিং করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে। কীভাবে খোলা যায়, সে লক্ষ্যে এগোতে হবে।
আগে শিক্ষক, পরে শিক্ষার্থীদের টিকা : শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা হয়েছে। আপাতত শিক্ষকদের টিকা দেওয়া হবে সবার আগে, এরপর শিক্ষার্থীদের।
এই কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে যারা টিকা নিতে পারছেন। এখন সব শিক্ষকের জন্য সুরক্ষা অ্যাপে একটি নতুন কলাম যুক্ত করা হয়েছে ‘শিক্ষক’। সেখানে নিবন্ধন করে ৪০ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সী শিক্ষকরা টিকা নিতে পারবেন। আর ৪০ বছরের নিচে যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তাদের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের রেজিস্টার্ড শিক্ষকদের ডেটা দিলে, সেই ডেটা আমরা ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) অন্তর্ভুক্ত করব। সেই তালিকা সম্পূর্ণ হলে আমরা ৪০ বছরের কম বয়সী শিক্ষকদের নিবন্ধন করতে বলব। তখন ওই ডেটার অন্তর্ভুক্ত শিক্ষকরাই নিবন্ধন করতে পারবেন, অন্য শিক্ষকরা পারবেন না।
৪০ বছরের কম বয়সী শিক্ষকদের নিবন্ধন শিগগির শুরু হবে জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, কিছু এমআইএস পরিবর্তন করতে হবে।
এ জন্য সোমবার (১ মার্চ) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বসবেন। তবে কবে থেকে নিবন্ধন শুরু হবে, সেটা নির্ভর করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কত দ্রুত আমাদের কাছে ডেটা পৌঁছে দেবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তালিকা দিয়েছে।
তারা বলেছে, চূড়ান্ত তালিকা দিতে দু-চার দিন সময় লাগবে। মন্ত্রণালয় নাম, এনআইডি নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য যখন দেবে, তখন এই তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগের ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। সে ক্ষেত্রে টিকাপ্রাপ্তির বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও টিকার সমস্যা হবে না, সময়মতো সব টিকা দিয়ে দেবে। সে ক্ষেত্রে টিকা না পেলে আমরা দিতে পারব না।
এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের তালিকা দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী হলে থাকেন, তাদের তালিকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ দেবে। তারা নিবন্ধন করে টিকা নেবেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, যেকোনো সময় টিকাদান শুরু হতে পারে। তারা তো আর একসঙ্গে তালিকা দেবে না। ধাপে ধাপে টিকা দেওয়া হবে। তালিকাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করবে কবে থেকে টিকাদান শুরু হবে। তবে যত শিগগির সম্ভব শুরু করে দেব। তবে কীভাবে টিকা দেওয়া হবে, সেটার ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা কীভাবে টিকা নেবেন, সেটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকাদান কেন্দ্র হবে, নাকি এখন যেসব কেন্দ্র রয়েছে, সেসব কেন্দ্রে, এসব নিয়ে ভাবছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে এই কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকাদান কেন্দ্র হতে পারে, অথবা যেসব কেন্দ্র রয়েছে, সেসব কেন্দ্রেই দেওয়া হতে পারে। তালিকা এলে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক টিকাদান কেন্দ্র করা যেতে পারে : আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, টিকাদানের ক্ষেত্রে যত বেশিসংখ্যক লোককে টিকা দেওয়া যায়, ততই ভালো। কিন্তু টিকা না হলে খোলা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। শিক্ষকরা অগ্রাধিকার তালিকায় আগে থেকেই ছিলেন। এখন তাদের নিবন্ধন তালিকার শীর্ষে আনা হয়েছে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে বিশেষ টিকাদান কেন্দ্র করা যেতে পারে। টিকা এখনো যথেষ্ট পরিমাণ আছে। কাজেই টিকা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
এখন যেসব কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে শিক্ষকরা টিকা নিচ্ছেন। যদি দীর্ঘ সময় লেগে যায় নিতে, সে ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বা পাশে টিকাদান কেন্দ্র করা যায় কি না, সে ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে। ৪০ বছরের নিচে ও ১৮ বছরের ওপরে যেসব শিক্ষার্থী থাকবেন, যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে, তখন আলাদা কেন্দ্রগুলোতে তারা টিকা নিতে পারবেন। সূত্র : দেশ রূপান্তর
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :