• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১
এনটিআরসিএ এর সুপারিশ

পুলিশ ভেরিফিকেশনে ঝুলে আছে ৩৮ হাজার শিক্ষক


নিউজ ডেস্ক অক্টোবর ১১, ২০২১, ১২:১৫ এএম
পুলিশ ভেরিফিকেশনে ঝুলে আছে ৩৮ হাজার শিক্ষক

ঢাকা : নাটোরের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। তিন বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর চলতি বছরের জুলাইয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সরকারি সুপারিশ পান। এরপরও তিনি কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারেননি। কবে পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় দিন কাটছে আব্দুল্লাহর।

কারণ সরকারের নতুন নিয়ম অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্র্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) থেকে সুপারিশ পাওয়া শিক্ষকদের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন।

কিন্তু এর ধীরগতির কারণে দীর্ঘ অপেক্ষা, ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার অবসান হচ্ছে না আব্দুল্লাহর মতো ৩৮ হাজার সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকের।

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘ আন্দোলনের পর রেজাল্ট হয়েছে। যত খুশি তত আবেদন এই নীতির কারণে আমি ৫০০টির বেশি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ চেয়ে আবেদন করেছি। যার পেছনে খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। এই টাকা সুদের ওপর ঋণ করেছি। এখন সুদের কিস্তি দিতে হচ্ছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া নিয়োগ হবে না। কবে হবে, আদৌ হবে কি না, কোনো আশা দেখছি না।’

লম্বা হচ্ছে শূন্য পদের তালিকা : দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত জুলাই মাসে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। এতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৩৮ হাজার ২৮৬ জনকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়।

অন্যদিকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন ২ হাজার ১৫৫ জন। যারা সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে সুপারিশপ্রাপ্ত। এসব প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ চলছে; যা করতে ইতিমধ্যে ৮ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ৩৮ হাজার প্রার্থীর একই ধরনের কাজ করতে দুই বছরও পেরিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক সংকট আরও গভীর হবে। গত মার্চ পর্যন্ত সরকারি হিসাব অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫৫ হাজার পদ শূন্য আছে। এই সংখ্যার সঙ্গে বর্তমানে আরও অন্তত ৫ হাজার নতুন করে যোগ হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের ২ হাজার ১৮০টি পদ শূন্য আছে।

হাবিবুল্লাহ রাজু নামে একজন নিয়োগপ্রত্যাশী বলেন, ‘পিএসসির অধীন ছাড়া অন্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পর এসব তথ্য (পুলিশ ভেরিফিকেশন) যাচাই-বাছাই করা হয়। ফলে এই শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এটি করা যেত। ফল প্রকাশের দিনই সরকার পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়।

কিন্তু ভেরিফিকেশনের এই ফরম প্রকাশ করতে এনটিআরসিএ সময় নেয় আরও ৪০ দিন। আমরা ফরম জমা দিয়ে অপেক্ষা করছি, কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না কবে নাগাদ এই অপেক্ষার অবসান ঘটবে।’

রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ পড়ার ভয় : জানা যায়, এত দিন বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা ছিল না। গত ১৫ জুলাই তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফলাফল প্রকাশের দিনই সরকার জানায়, এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত এসব শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই করবে।

কারণ হিসেবে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ঘটনা বেড়েছে। ফলে কোনো দুষ্কৃতকারী যাতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে না পারে, সে জন্য এই ব্যবস্থা।

বিষয়টিকে নিয়োগপ্রত্যাশীদের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। তাদের ধারণা, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে। ফলে নিয়োগ থেকে বাদ পড়তে পারেন ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী রাজনীতির সমর্থকরা।

এ ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে পুলিশি দুর্নীতি উৎসাহিত হতে পারে।

পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে চাকরিপ্রত্যাশীরা বলছেন, ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানির সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। টাকা ছাড়া এই ভেরিফিকেশন আটকে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং নানা জটিলতায় ভরা। ফলে এটি আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত আগস্ট মাসে এনটিআরসিএ থেকে পাঠানো সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের তালিকা পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এটি শেষ করতে কত দিন লাগবে, এ বিষয়ে নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফৌজিয়া জাফরীন (মাধ্যমিক) বলেন, ‘এনটিআরসিএ যে তালিকা পাঠিয়েছে, সেটি আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। এখন এটি তারা দেখভাল করছে। ফলে তাদের কত দিন লাগবে, এ বিষয়ে আমরা বলতে পারব না। তবে স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা যায় যে বেশ সময় লাগতে পারে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প নেই।’

এনটিআরসিএ কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া অনেক শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত।

এ ছাড়া অনেকের নামে বিভিন্ন মামলা রয়েছে। তাদের বিষয়ে যাচাই করতেই এই পুলিশ ভেরিফিকেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এনটিআরসিএ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করা প্রার্থীদের সব তথ্য নেওয়া হয়েছে টেলিটক থেকে। যেখানে ৩৮ হাজার ২৮৬ জন প্রার্থীর সব তথ্য মিলিয়ে মোট ১৪ হাজার পৃষ্ঠা হয়।

পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার পরই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা এনটিআরসিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।

দীর্ঘ হচ্ছে বেকারত্বের হতাশা : এনটিআরসিএ থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন এমন যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা প্রত্যেকেই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। বেশিরভাগই টিউশনি অথবা অস্থায়ী কিণ্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতায় যুক্ত। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে তাদের বেশিরভাগই শোচনীয় অবস্থায় পড়েন।

গত বছরের জানুয়ারিতে এনটিআরসিএর সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একটি ভালো চাকরির আশায় বুক বেঁধেছিলেন তারা সবাই।

পরে সরকার বিষয় ও পদভিত্তিক নিয়োগ সুপারিশের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দিলে প্রত্যেকে ধারদেনা করে আবেদন করেন। কেউ কেউ ১ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ে আবেদন করেন। এতে তাদের খরচ হয়েছে লাখ টাকারও বেশি।

এনটিআরসিএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৫৪ হাজার ৩০৪ জন শূন্য পদে নিয়োগের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ৯০ লাখ। সে হিসাবে একটি পদের বিপরীতে ১৬০ জনের বেশি আবেদন করেন। প্রতিটি আবেদনে এনটিআরসিএ নিয়েছে ১০০ টাকা করে। এতে প্রতিষ্ঠানটি এসব বেকারের কাছ থেকে নিয়েছে ৯০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া আবেদন ফরম পূরণ ও টেলিটকে মেসেজ প্রদান খরচসহ নানাভাবে প্রত্যেক আবেদনকারী প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি খরচ করেছেন। আবেদনকারীদের অনেকেই এসব টাকা ঋণ করে সংগ্রহ করেছেন। এখনো চাকরির নিয়োগ না পেলেও তাদের ওই টাকার সুদের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে।

বগুড়ার সুপারিশপ্রাপ্ত এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এই একটা চাকরির পেছনে আমার যত দৌড়ঝাঁপ, খরচ, ভোগান্তি, দুশ্চিন্তা গেছে, তা বর্ণনার বাইরে। আমি খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এখন পুলিশ ভেরিফিকেশনে এসে যদি আবার টাকা চায়, তাহলে আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!