ঢাকা : করোনার কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ ছিল। এর ফলে লাখ লাখ অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের গত বছর স্কুলে ভর্তি করেনি, কিন্তু নামিদামি স্কুলগুলোর বেশির ভাগই স্কুলে ভর্তির সর্বোচ্চ বয়স সাড়ে তিন থেকে চার বছর নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ফলে যে শিশুদের বয়স চার বছর পার হয়ে গেছে, তাদের নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন অভিভাবকরা।
জানুয়ারি থেকে শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষ। নতুন শিক্ষাবর্ষে সন্তানদের স্কুলে ভর্তিতে এরই মধ্যে অভিভাবকরা পড়েছেন ‘বয়স’ নিয়ে জটিলতায়।
এর ফলে করোনার সময় যে শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয়নি, তাদের মধ্যে যাদের বয়স সাড়ে তিন বা চারের বেশি হয়ে গেছে, তাদের কী হবে, এমন প্রশ্নে একাধিক স্কুলের শিক্ষক-কর্মকর্তারা যুক্তি দেখান, স্কুল বন্ধ থাকলেও তারা ভর্তি নিয়েছেন।
হাজার হাজার শিশুর ভর্তি নিয়ে জটিলতায় পড়লেও সরকারের শিক্ষা বিভাগের এ নিয়ে কোনো ভাবান্তরই নেই।
রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের একটি স্কুলে এক শিশুর জন্য ভর্তির ফরম তুলতে গেলে প্রথমে তারা ফরম দিতে চাইছিল না। তারা প্লে গ্রুপে সর্বোচ্চ সাড়ে চার বছর বয়সী শিশুকে ভর্তি করবে বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। যে শিশু ভর্তি হবে, তার জন্ম ২০১৭ সালের ২০ জুন। ৩১ ডিসেম্বর হিসাব করে স্কুল থেকে বলা হয় বয়স ১১ দিন বেশি হয়, ফরম দেওয়া যাবে না। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নানাভাবে যোগাযোগ করে ফরম আনা হয়। রাজধানীর কুড়িলে আরেক স্কুল নেভি অ্যাংকর স্কুল ও কলেজে একই শিশুর জন্য ফরম তুলতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তারা সাড়ে তিন থেকে চার বছরের শিশুকে প্লে-গ্রুপে ভর্তি নেবে, কিন্তু ওই শিশুটির বয়স সাড়ে চার। যিনি ফরম দেন, তিনি বলেন, এক দুই মাস বেশি হলেও দেওয়া যেত, কিন্তু ছয় মাস বেশি বসয় শিক্ষকরা মানবেন না।
করোনার ছুটি শেষে স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে উদ্ভূত জটিলতার কথা জানালেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, ‘স্যরি, কিন্ডারগার্ডেন আমাদের আওতাভুক্ত না। এ নিয়ে মন্তব্য করতে করতে চাই না। প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করা হয়।’
২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের বয়স ৬ এর বেশি হতে হবে। কোনো অভিভাবক যদি ৭ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করতে চান, তাহলে তার কোনো বাধা নেই। তাহলে প্রাক প্রাথমিকে স্কুলগুলোর এভাবে সর্বনিম্ন বয়স বেঁধে দেওয়ার কোনো আইনি ভিত্তি আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ভুক্তভোগী অভিভাবকরা।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে পুরো পৃথিবীই বিপর্যস্ত। সুতরাং বিশেষ এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষে স্কুলগুলোর বয়স ছাড় দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। কেননা বিশেষ এ পরিস্থিতির ভুক্তভোগী শিশুরা হবে কেন?
তিনি বলেন, প্রাক-প্রাথমিকের জন্য সরকারের অবশ্যই একটি নীতিমালা থাকা উচিত। নীতিমালা না থাকার কারণেই বিভিন্ন স্কুল নিজেদের মতো করে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে, যা প্রত্যাশিত নয়।
স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়স জটিলতায় পড়েছেন রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা জান্নাত আক্তার। তার ছেলে আরিয়ান হোসেনের বয়স এখন ৬ বছর। করোনায় যখন স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, তখন ছিল সোয়া চার বছর। গত বছরের জুনে ভর্তি করার পরিকল্পনা ছিল।
স্কুল বন্ধ থাকায় তার ছেলেকে আর ভর্তি করেননি জান্নাত। এখন বিভিন্ন স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্কুল থেকে বলা হচ্ছে, বাচ্চার বয়স বেশি।
জান্নাত আক্তার বলেন, কয়েকটি স্কুল থেকে বলল, বাংলা মাধ্যমের লোয়ার শিশু শ্রেণিতে ভর্তি বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে চার থেকে সাড়ে চার বছর, আর আপার শিশু শ্রেণিতে সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ বছর এবং ইংরেজি মাধ্যমে প্লে শ্রেণিতে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর, নার্সারিতে চার থেকে সাড়ে চার বছর। এতে পড়েছি সমস্যায়।
তিনি বলেন, আমার ইচ্ছা ছেলেকে আগামী শিক্ষাবর্ষে আপার শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করব। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ায় ওকে আপার শিশু শ্রেণিতে কোথায় ভর্তি করব তা বুঝতে পারছি না।
একই সমস্যায় পড়েছেন মগবাজারের বাসিন্দা আরশাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, আমার মেয়ে আনিশা চৌধুরীর বয়স এখন সাড়ে ৫ বছর। বাসার পাশে দুটি স্কুলে ভর্তির খোঁজ নিয়ে জানা গেল প্লে গ্রুপে তাকে ভর্তি করা সম্ভব না। কারণ ওর বয়স বেশি হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে ইস্পাহানি বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাদেকা বেগম বলেন, ভর্তিতে বয়স নির্ধারণের বিষয়টি নির্ধারণ করে সরকার। যেমন গত বছর সরকার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে ৬ বছর প্লাস নির্ধারণ করেছিল। আমরা সে মোতাবেক ভর্তি করেছি। আর প্রাক-প্রাথমিকে সরকার থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমাদের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী বয়স নির্ধারণ করে ভর্তি করা হয়েছে।
একই কথা বললেন ইস্কাটন গার্ডেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক দুলাল চন্দ্র চৌধুরী। তিনি বলেন, গত বছর প্রথম শ্রেণিতে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রাক-প্রাথমিকে আমরা আমাদের মতো করে বয়স নির্ধারণ করেছি।
বয়স জটিলতা কাটাতে সব শ্রেণিতে বয়স নির্ধারণের পক্ষে প্রভাতী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাহিদা চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকারের শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু প্রাক-প্রাথমিকে বয়স নির্ধারণ করা হয়নি। এতে প্রাক-প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তিতে নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। আমি মনে করি, প্রথম শ্রেণির মতো প্রাক-প্রাথমিকেও বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।
করোনার সময় স্কুল বন্ধ ছিল। অন্তত এবার কেন বয়সের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না- এমন প্রশ্নে ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, স্কুল বন্ধ থাকলেও আমরা তো অনলাইনে ভর্তি নিয়েছি। এখানে কিছুই করার নেই।
প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি বয়স জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুল ভর্তি নীতিমালা-২০২১ কমিটির সদস্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (বিদ্যালয়) বেলাল হোসাইন বলেন, গত বছর আমরা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে ৬ বছর প্লাস বয়স নির্ধারণ করেছিলাম। সরকারি এবং বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) বিদ্যালয়গুলো আমাদের নির্ধারিত বয়স ধরেই ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। তবে প্রাক-প্রাথমিকে কোনো বয়স নির্ধারণ করা হয়নি। বিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো করে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি করেছিল।
করোনার কারণে যাদের বয়স বেড়ে গেছে সেসব শিক্ষার্থীর ভর্তির কী হবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রাক-প্রাথমিকের বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। কিন্তু প্রথম শ্রেণির জন্য ভর্তিতে ৬ বছর প্লাস উল্লেখ করেছিলাম যেন কারো বয়স ৬ বছরের বেশি হলেও আবেদন করতে পারে।
করোনা কারণে যেসব শিক্ষার্থীর এক বছর হারিয়ে গেল, তাদের প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তিতে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বয়স নির্ধারণ করার জন্য স্কুলগুলোকে পরামর্শ দেন তিনি।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রায় দেড় বছর পর গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজে ক্লাস শুরু হয়। তবে প্রতিদিন সব শ্রেণিতে ক্লাস হচ্ছে না।
শুধু চলতি বছরের ও আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। আর অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম, নবম শ্রেণিতে দুই দিন এবং অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক দিন ক্লাসে আসতে বলা হয়েছে।
এই সময়ে স্কুলে কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। ক্লাস চলেছে অনলাইনে। এমনকি প্লে ও কেজি শ্রেণিতেও ক্লাস নেওয়া হয়েছে অনলাইনে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :