ঢাকা : করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি। ভিন্ন মূল্যায়নে তখন সবাই পাস করেছিলেন। পরের বছর শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছিল। তখন পাসের হার হয়েছিল প্রায় ৯৬ শতাংশ। আর গতবার (২০২২) পরীক্ষা হয়েছিল একেকটি বিষয়ে অর্ধেক নম্বরের ভিত্তিতে। তখন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে পরীক্ষাই হয়নি। তাতে পাসের হার হয় ৮৪ শতাংশের বেশি।
কিন্তু এবার পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা হলেও একটি বাদে সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে পূর্ণ নম্বরে। শুধু আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষা শেষ সময়ে এসে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৭৫ নম্বরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এবার ফল আগের তিন বছরের তুলনায় বেশ খারাপ হয়েছে। পাসের হার গতবারের চেয়ে ৮ শতাংশ কমে গেছে। আর ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ কমেছে গতবারের চেয়ে অর্ধেকের বেশি।
করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষার দিকে যত এগোচ্ছে দেশ, পরীক্ষার ফলও তুলনামূলকভাবে খারাপ হচ্ছে। করোনার আগের অবস্থায় ফিরছে ফলাফল। এবারের ফলাফল প্রসঙ্গে নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, এবার সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে।
এ ছাড়া এবার যারা পাস করেছেন, তারা করোনার সময়ে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়তেন। সেই সময়ে অনলাইন ক্লাসের ফলে অনেকেরই ভিত্তি একটু দুর্বল ছিল। তবে তার কলেজে শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষার দিকে যত এগোচ্ছে, পরীক্ষার ফলও তুলনামূলকভাবে খারাপ হচ্ছে। তবে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলকে খারাপ বলতে চান না।
তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির আগের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে বরং এবারের ফলাফল ভালো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তারা বললেন, করোনা শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৭২ শতাংশ। এবার পাসের হার প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে।
২০১৭ সালে পাসের হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ, আর ২০১৬ সালে ছিল ৭২ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ওই বছরগুলোতে পাসের হারের তারতম্য কাছাকাছি থাকত। এবারের ফলাফল ওই সময়ের ফলাফলকে মনে করিয়ে দিল।
গত রবিবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৪। গতবার এই হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫। এ বছর পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ।
অন্যদিকে দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সাড়ে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। সেই হিসাবে এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৮৩ হাজার ৬৮৭ জন।
ফলাফলের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারও সেই পুরনো বিষয়, ইংরেজির প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলের ওপর। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের কয়েকটি বিষয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার ইংরেজি বিষয়েতুলনামূলকভাবে খারাপ ফল করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এর মধ্যে কোনো কোনো শিক্ষা বোর্ড ইংরেজিতে বেশি খারাপ করেছে। যেমন যশোর শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৭৭ শতাংশের কিছু বেশি। এই বোর্ডে এবার পাসের হারও সবচেয়ে কম। ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৭৫ শতাংশের মতো। এই বোর্ডেও পাসের হার সার্বিক গড় পাসের হারের চেয়ে কম।
সবকিছুতে এগিয়ে ছাত্রীরা : সিলেট বোর্ডের অধীনে এইচএসসির ফলাফলে সব সূচকে এগিয়ে আছেন ছাত্রীরা। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে রয়েছেন মেয়েরা। এবার ৪৮ হাজার ৭৫১ ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছেন ৩৫ হাজার ৬২০ জন। পাসের হার ৭৩ দশমিক শূন্য ৭। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৮৮০ জন।
এদিকে ছাত্রদের পাসের হার ৬৯ দশমিক ৫৮। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৩৪ হাজার ৩৭২ জন ছাত্র। এর মধ্যে পাস করেছেন ২৩ হাজার ৯১৬ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৮১৯ জন।
এইচএসসিতে পাসে মেয়েরা এগিয়ে, ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ খুঁজতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ চন্দ্র পাল বলেন, সিলেটে ছাত্রদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এ জন্য ছাত্রদের সংখ্যা কম। এ ছাড়া ছাত্রীরা পড়াশোনায় বেশি মনোযোগী হওয়ায় পাসের হার বেশি।
বিভাগভিত্তিক পাসের হারে এগিয়ে রয়েছেন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা। এ বিভাগে পাসের হার ৮২ দশমিক ৩৪। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৩৩৫ জন। মানবিকে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৭২। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ২৫৮ জন। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৪২। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১০৬ শিক্ষার্থী।
গতবারের চেয়ে জিপিএ-৫ কমেছে ৮১ হাজার : পাঁচ বছরের তুলনামূলক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার আগে ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৪১ হাজার ৮০৭ জন। পরের বছর বেড়ে হয়েছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬১৪ জন। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন এবং এর পরের বছর পান ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৫ জন। এবার তা কমে হয়েছে ৭৮ হাজার ৫২১। গতবারের চেয়ে এবার ৮১ হাজার ২৩৪ জন শিক্ষার্থী কম জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
শূন্য ভাগ, শতভাগ পাসের চিত্র : এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার শূন্য পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। এ বছর শূন্য পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৪২টি। ২০২২ সালে ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। এদিকে এবার সবাই পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। ৯৫৩ প্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থী এ বছর পাস করেছে। গতবার এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৩০টি।
জিপিএ-৫ কমেছে অর্ধেকের বেশি : এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এ বছর পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুটোই কমেছে। চলতি বছরে এ বোর্ডের পাসের হার এসেছে ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ; যা গত বছর ছিল ৮০ শতাংশের বেশি।
এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬ হাজার ৩৩৯ জন শিক্ষার্থী, যা গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৬৭৯ জন।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান বলেন, এবারে এই বোর্ড থেকে পরীক্ষায় বসেছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৯৪৯ জন শিক্ষার্থী। ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে পাস করেছেন ৭৫ হাজার ৯০৩ জন। অর্থাৎ পাসের হার ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া এই বোর্ডে এগিয়ে ছাত্রীরা। ছাত্রীদের পাসের হার ৭৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর ৭১ দশমিক ২৪ শতাংশ ছাত্র পাস করেছে এবারের এইচএসসিতে। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল
এমটিআই