• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
কোটা বিরোধী আন্দোলন

কোন ছাত্র সংগঠন কোন অবস্থানে


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ১১, ২০২৪, ০৩:৩২ পিএম
কোন ছাত্র সংগঠন কোন অবস্থানে

ঢাকার শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে কোটাবিরোধীরা

ঢাকা : আপাতত সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে সে আদেশ অমান্য করে আবারও আন্দোলন শুরু করেছেন কোটা প্রথা বাতিলের পক্ষে শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’- এই ব্যানারে চলছে কর্মসূচি।

এর আগে ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেল ‘সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’। ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মীরা সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেও ছাত্র সংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে তাতে যুক্ত ছিল না। এরবাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের বিক্ষোভেও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের দেখা যাচ্ছে; তবে সামনের সারির কোনও ছাত্র সংগঠনকে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে না।

২০১৮ সালের পরে নুরুল হক নুরুদের ‘সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর সঙ্গ ছেড়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামে একটি সংগঠন হয়েছিল। সেই সংগঠনের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে দেখা যাচ্ছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে। তাদের এই আন্দোলন নিয়ে কী ভাবছে ছাত্রসংগঠনগুলো? জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে।

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আন্দোলনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোনও অবস্থানই নিচ্ছে না। বিএনপি এই আন্দোলনকে সমর্থন করলেও তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল আন্দোলনে সক্রিয় নেই। তবে আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন রয়েছে তাদের। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর কেউ এই আন্দোলনে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে আছে, কেউবা দূরে থেকেই কথা বলছেন। তবে এই সংগঠনগুলোর সবাই কোটা সংস্কারের পক্ষে।

ছাত্রলীগ : ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলছেন, কোটা নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার অবসানে একটি কমিশন গঠন করা যায়। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, আইনগত প্রক্রিয়ায় এটা করতে হবে। সরকার পক্ষ আপিল করেছে। মেধাভিত্তিক কর্মসংস্থান গড়ে তোলা দরকার। যৌক্তিক পথেই এগোচ্ছে।

কোটা পুরোপুরি তুলে দেওয়ার পক্ষপাতি কি না- এই প্রশ্নে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, এটা সরকারের পলিসিগত বিষয়। (আন্দোলন করে) জনদুর্ভোগ তৈরি করা হচ্ছে। সেটা না করে যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনে কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

ছাত্রলীগ এই আন্দোলনকে সমর্থন করছে কি না- এই প্রশ্নও এড়িয়ে গিয়ে সাদ্দাম বলেন, আমরা কারও বিরুদ্ধে বলব, সেটা নয়। বিষয়টি বিচারাধীন ব্যাপার। ছাত্রলীগের দাবি আদায়ের নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে কথা বলছি।

তবে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। তার মত, তৃতীয় পক্ষ যাতে এর কোনও সুযোগ না নিতে পারে। সে বিষয়টি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নজরে রাখতে হবে।

ছাত্রদল : ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলছেন, ‘অরাজনৈতিক’ এই আন্দোলনে তাদের সমর্থন থাকলেও তারা নেতৃত্বে যেতে চান না। তিনি বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকে অবশ্যই সমর্থন করছি। এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতি রয়েছে, যাতে ছাত্রদলের মৌন সমর্থন রয়েছে।

ছাত্রদল সাংগঠনিকভাবে নেতা-কর্মীদের আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কোনও নির্দেশনা দিয়েছে কি না- এই প্রশ্নে রাকিব বলেন, বর্তমানে যে ব্যানারে আন্দোলন চলছে, এটা অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। আমরাও চাই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এই আন্দোলন বাস্তবায়ন হোক।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রদলের যেসব শিক্ষার্থীরা অধ্যায়নরত, তারা স্বতস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় নাই।

ছাত্রদল কোটা পুরোপুরি তুলে দেওয়ার পক্ষপাতি কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, এই মূহূর্তে আমরা চাই, কোটা তুলে দেওয়া হোক। যারা অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী রয়েছে তাদের জন্য সামান্য কিছু কোটা থাকতে পারে।

নারী কোটা নিয়ে ছাত্রদল সভাপতি বলেন, আমি তো বললাম, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী। নারীরা কোটা নিয়ে প্রশাসনে যেতে চায় না। যারা আন্দোলন করছে, তাদের কাছে জানতে পারেন।

ছাত্র ইউনিয়ন : বাম সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশের নেতারাই বলছেন, কোটা পদ্ধতি বাতিল নয়, সংস্কার প্রয়োজন। সংগঠনটির একাংশের সভাপতি রাগীব নাইম বলেন, কোটা হালনাগাদ করা জরুরি। নারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি যদি নারীরা অগ্রসর হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে কোটা কমিয়ে নিয়ে আনা যেতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তিনি বলেন, তৃতীয় প্রজন্ম কোটার আওতায় আসতে পারবে না। তবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে যারা বিভিন্ন সময়ে হামলার শিকার হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ক্ষেত্রে সে কোটা থাকতে পারে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম নেই। বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে কোটাই একমাত্র হাতিয়ার নয় বলে মনে করেন রাগীব।

তার সংগঠনের কর্মীরা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অংশ নিচ্ছি বলতে ব্যানার নিয়ে অংশ নিচ্ছি না, তবে ঢাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা শুরু থেকেই আন্দোলনে আছে।

ছাত্র ইউনিয়নের আরেক অংশের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার বলেন, আমরা কোটা বাতিল চাচ্ছি না। কোটা সংস্কার যৌক্তিক। আমরা কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার চাচ্ছি। যেটা হওয়া উচিৎ। কোটা সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনিও।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়ে মাহির বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের এখন তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। সেক্ষেত্রে এই কোটা কত শতাংশ থাকবে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।

প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, নারী এবং ক্ষেত্রবিশেষে জেলা কোটাও রাখার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, তবে সরকারি অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রে যে সব পোষ্য কোটা আছে, যেমন রেলওয়ের পোষ্য কোটা, এগুলো বাতিল করতে হবে। আর সারাদেশে যে কোটা বিরোধী আন্দোলন চলছে, তাতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে বলে জানান মাহির।

ছাত্রফ্রন্ট : সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের দুই অংশই কোটা সংস্কারের পক্ষে। একাংশের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ বলেন, কোটার যৌক্তিক সংস্কার করা প্রয়োজন। যৌক্তিক সংস্কার না করে এটাকে জিইয়ে রেখে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে সেটা আবার ফিরিয়ে আনা হলো, এটাও একটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমতায় নিয়ে আসতে হলে কোটা ব্যবস্থার দরকার বলে মনে করেন তিনি।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আরেক অংশের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, “০১৮ সালে যে আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল, সেখানে আমরা ছিলাম। এখনও আমরা আছি। এই আন্দোলন কমন একটা প্ল্যাটফর্মে হবে। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীদের ভিন্ন বক্তব্য আছে। আমরা তা নিয়েই আছি।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা না রাখার পক্ষে অবস্থান জানিয়ে সালমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা অযৌক্তিক। পুরোটা বাতিল করা উচিৎ। নারী, প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য যৌক্তিক কোটা থাকতে পারে।

বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী : মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পক্ষে বাম ছাত্র সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী। সংগঠনের সভাপতি দিলীপ রায় বলেন, আমরা মনে করি, মুক্তিযোদ্ধা কোটা যে ৩০ শতাংশ আছে, সেটা বাতিল করা দরকার। মুক্তিযোদ্ধা কোটা এখন সামাজিক বৈষম্য হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তবে নারী, প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীদের কোটা বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান জানান তিনি।

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলন থেকে যে দাবি তোলা হয়েছে, তা ‘জনতুষ্টিবাদী আলাপ’ বলে মন্তব্য করেন দিলীপ বলেন, আমরা মনে করি, আন্দোলনকে ভেতর থেকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া দরকার।

ছাত্র ফেডারেশন : বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন কোটা সংস্কারের যেমন পক্ষপাতি, তেমনি এই আন্দোলনেও সক্রিয়। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, কোটা আন্দোলন যৌক্তিক বলে মনে করি। এই আন্দোলনে আমাদের সংহতি আছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যে আন্দোলন হচ্ছে, সেখানে আমাদের নেতা-কর্মীরা আছে।

৫৬ শতাংশ কোটা যৌক্তিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, যৌক্তিক সংস্কার করা দরকার। ছাত্রদের দিকে এই সমস্যার সমাধান চাওয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের এই গবেষণা করা দরকার। তাদের উচিৎ এই গবেষণা করে সমাধান করা।

ছাত্র অধিকার পরিষদ : ২০১৮ সালের আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ একই দাবি নিয়ে এবারের আন্দোলনেও রয়েছে। দলীয় ব্যানারে এই আন্দোলনে অংশ না নিলেও সাংগঠনিকভাবে কোটা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে সংগঠনের সভাপতি মোল্লা রহমত উল্লাহ।

তিনি বলেন, আমরা এই আন্দোলনে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত এই আন্দোলনে সফলতা না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মাঠ ছাড়ব না। কারণ এই আন্দোলনের জন্য আমাদের ভাইদের ২০১৮ সালে রক্ত ঝরেছে, গুলি খেয়েছে।

কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের দাবি তুলে রহমত উল্লাহ বলেন, আমরা ২০১৮ সালেও সংস্কার চেয়েছি। এখনও সংস্কার চাই। ক্ষুদ্র- নৃগোষ্ঠী ও অনগ্রসর জাতির জন্য কোটা থাকতে পারে।

গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি : এবারের আন্দোলনে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম, যিনি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব। কোটা ব্যবস্থা বাতিল না সংস্কার চান- এই প্রশ্নে নাহিদ জানান, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রেখে সংস্কার চান তারা।

সেটা কত অংশ- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫ থেকে ৭ অথবা ১০ শতাংশ হতে পারে। এটা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করি নাই। ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে পরে সংশোধনী আনতে পারে।

সেক্ষেত্রে আন্দোলনের কর্মসূচি থেকে কোটা বাতিলের স্লোগান ওঠা সাংঘর্ষিক হয়ে যায় কি না- প্রশ্নে নাহিদ বলেন, না, সাংঘর্ষিক না। আমরা যখন কোটা বাতিল বলি, তখন ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিল বলি।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করছে জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হয়েছে।

তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নাহিদ বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনও বক্তব্য পাইনি। রাষ্ট্রপক্ষ নিয়মতান্ত্রিকভাবে আপিল করেছেন। স্পষ্ট বক্তব্য না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!