কক্সবাজার: রাখাইন ভাষাভাষী হয়েও বাংলা ভাষা শিক্ষার উজ্জ্বল দক্ষতার অনন্য নাম মাসিন রাখাইন। কক্সবাজারের মত অনুন্নত শহরে ৭০ দশকে তিনি জ্ঞানের মশাল হাতে নিয়ে আলো ছড়াতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। একজন রাখাইন ভাষাভাষী হয়েও বাংলায় পড়া লেখা করে বাংলায় শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তারপর বাংলা ভাষায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন এই শহরে। আদিবাসী রাখাইনদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম কক্সবাজারে গ্রাজুয়েশন করা মাসিন রাখাইন।
মাসিন রাখাইনের জন্ম ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি কক্সবাজারের টেক পাড়ার হাঙ্গর পাড়া এলাকায়। ১৯৫৬ সালে বার্মিজ স্কুল নামের এক স্কুলে মর্নিং শিফটে ভর্তি হন তিনি। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি এই বার্মিজ স্কুলটিতে দুই শিফটে পাঠদান করা হয়। এই অঞ্চল রাখাইন অধ্যুষিত হওয়ায় রাখাইন ভাষা শিক্ষা দানের জন্য মর্নিং শিফট এবং বাংলা ও অন্যান্য শিক্ষার জন্য ডে শিফট চালু ছিলো। মাসিন রাখাইন পড়ালেখা ভাল হওয়ায়, শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন ভালো ছাত্রী হিসাবে। শিক্ষকদের অনুরোধে মাসিনের বাবা মেয়েকে ডে শিফটে বাংলা শিক্ষায় ভর্তি করান।
স্কুল থেকে সফলতার সাথে প্রাইমারি স্কুল শেষ করে ১৯৬১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন রাখাইন। ১৯৬৬ সালে তিনি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে আই এ ও ১৯৭০ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯৭৭ সালে পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয় হতে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন।
১৯৭০ সালের ১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে বার্মিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেকড়ি হয় তার। তিনি ১৯৯০ সালের ১৬ মে পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর শুভ সহকারী শিক্ষক হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালের ১৭ মে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেয়ে বিমানবন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যোগদান করেন মাসিন। ১৯৯১ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে আবরও বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুনরায় বদলি হয়ে যান। এই স্কুল থেকে ২০০৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আজ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সমুদ্রের শহর কক্সবাজারে জ্ঞানের মশাল ছড়ানো এই মহীয়সী নারীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মাসিন রাখাইনের সাথে বলতেই তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। ভাড়ে নুয়ে পড়া ৭৫ বছর বয়সী মাসিন সোনালীনিউজকে বলেন, একজন রাখাইন হয়েও কক্সবাজারে বাংলা ভাষায় পড়তে গিয়ে এবং বাংলা ভাষায় পড়াতে গিয়ে কত কিছুর সম্মুখীন হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। বর্তমান সময়ে ছাত্রদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা আর শিক্ষক ছাত্রদের পড়ালেখার মান দেখলে অবাক হই। আমি এখনো আমার বাড়ির আশেপাশের ছেলে মেয়েরা পড়ালেখা করলে রাতে গিয়ে তাদের দেখে আসি কেমনভাবে পড়ছে কিভাবে পড়ছে।
তিনি বলেন, আমরা প্রাইভেট পড়াতাম না। ভালোভাবে বুঝিয়ে পড়াতাম। স্কুল ছুটির পর এলাকায় পাড়ায় মহল্লার ছাত্রদের বাসায় বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নিতাম, তাদেরকে পড়া দেখিয়ে দিতাম। স্কুলে না আসলে বাসা থেকে গিয়ে নিয়ে আসতাম। আমি প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর বেতনের অর্ধেক টাকা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যই খরচ করেছি। অনেক সময় দেখা যেত দুপুরের খাবারের বিরতিতে বাসায় খেতে গেলে আর আসে না। বাবা মা খাবার দিতে না পারলে তারা আর আসতো না। অনেক চিন্তার পর শেষমেশ অনেক দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে টিফিন করাইতাম। বাসায় যেতে দিতাম না। এভাবে আমরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পড়ালেখা করিয়েছি।
এসএস