ঢাকা : গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন ঘিরে ঘটনাপ্রবাহে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার পাস করেছে ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। দ্বাদশ শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পর্যায়ে পা রাখতে যাওয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে, যা উত্তীর্ণের মোট সংখ্যার ১৪ শতাংশ।
এর আগে ২০২৩ সালে এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ; তাদের মধ্যে ৯২ হাজার ৫৯৫ জন জিপিএ ৫ পেয়েছিল। এই হিসাবে ২০২৪ সালের পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে দশমিক ৮৬ শতাংশ পয়েন্ট। তবে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ হাজার ৩১৬ জন।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বেলা ১১টায় বোর্ড চেয়ারম্যানরা নিজেদের অফিসে বসে ফল প্রকাশ করেন। ঢাকায় সমন্বিত ফলাফল প্রকাশ করেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার।
বরাবরের মতই শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইটের পাশাপাশি মোবাইলে এসএমএস করেও উচ্চমাধ্যমিকের ফল জানা যাচ্ছে।
# এগারোটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন শিক্ষার্থী এবার পরীক্ষায় অংশ নেয়।
# তাদের মধ্যে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন পাস করেছে। সার্বিক পাসের হার ৭৭.৭৮%
# নয় সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৫.৫৬%, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন।
# মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯৩.৪০ %, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৬১৩ জন।
# কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৮৮.০৯%, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৯২২ জন।
# সার্বিকভাবে ছাত্রদের মধ্যে পাসের হার ৭৫.৬১%, ছাত্রীদের মধ্যে পাস করেছে ৭৯.৯৫%
# জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৪ হাজার ৯৮৭ জন ছাত্র এবং ৮০ হাজার ৯৩৩ জন ছাত্রী।
কোভিড মহামারীর পর গতবছরই প্রথমবার পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা হয়েছিল। আর এ বছর সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়ার পর বাকিগুলো আর নেওয়া সম্ভব হয়নি ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং সরকার পতনের পরের ঘটনাপ্রবাহের কারণে।
২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষা কোভিড মহামারী আর বন্যার কারণে বিলম্বিত হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হওয়া সেই পরীক্ষায় ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে। জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন।
মহামারীর কারণে বিলম্বিত হয়েছিল ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষাও। কম বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ; ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন পায় জিপিএ-৫।
আর ২০২০ সালে মহামারীর কারণে পরীক্ষা হয়নি। জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নে সবাই পাস করে, জিপিএ-৫ পায় এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন।
মহামারী শুরুর আগে ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় সার্বিকভাবে পাস করে ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে মোট ৪৭ হাজার ২৮৬ জন শিক্ষার্থী পাঁচে পাঁচ জিপিএ পায়।
২০২০ সালে পরীক্ষা না নিয়ে ফল প্রকাশের অভিজ্ঞতা এবার আংশিক কাজে লেগেছে। যে কটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। যে পরীক্ষাগুলো হয়নি, সেগুলোর ক্ষেত্রে এসএসসির নম্বর বিবেচনায় নিয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে করা হয়েছে মূল্যায়ন।
সাতটি বিষয়ের পরীক্ষার পর আটকে থাকা বিষয়গুলোর পরীক্ষা যে আর হচ্ছে না, সে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল গত ২০ অগাস্ট। কিন্তু ফল কীভাবে প্রকাশ করা হবে তা ঠিক করতে সময় লেগে যায়। সাড়ে ১৩ লাখ পরীক্ষার্থীর সেই অপেক্ষার অবসান হল মঙ্গলবার।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্ধারিত দিন সকালে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতা সারতেন সরকারপ্রধান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার হাতে ফলের প্রতিবেদন তুলে দিতেন বোর্ডের চেয়ারম্যানরা। শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা থাকতেন ওই অনুষ্ঠানে।
সরকারপ্রধান আনুষ্ঠানিকতা সারার পর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ওয়েবসাইট ও মোবাইলে ফল জানার সুযোগ মিলত। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে সারাদেশের বিস্তারিত ফলাফলের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতেন।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এবার ফল প্রকাশের সেসব আনুষ্ঠানিকতা রাখা হয়নি। গণমাধ্যমকর্মীরা পরিসংখ্যান পেয়েছেন বোর্ড থেকে।
এক নজরে ফলাফল
বোর্ড |
পাস (%) |
জিপিএ-৫ (জন) |
পাস (%) |
জিপিএ-৫ (জন) |
পাস (%) |
জিপিএ-৫ (জন) |
পাস (%) |
জিপিএ-৫ (জন) |
পাস (%) |
জিপিএ-৫ (জন) |
|
২০২৪ |
|
২০২৩ |
|
২০২২ |
|
২০২১ |
|
২০২০ |
|
ঢাকা |
৭৯.২১ |
৪৮,৫৪৮ |
৭৯.৪৪ |
৩১,৭৫২ |
৮৭.৮৩ |
৬২,৪২১ |
৯৬.২০ |
৫৯,২৩৩ |
১০০ |
৫৭,৯২৬ |
রাজশাহী |
৮১.২৪ |
২৪,৯০২ |
৭৮.৪৬ |
১১,২৫৮ |
৮১.৬০ |
২১,৮৫৫ |
৯৭.২৯ |
৩২,৮০০ |
১০০ |
২৬,৫৬৮ |
কুমিল্লা |
৭১.১৫ |
৭,৯২২ |
৭৫.৩৯ |
৫,৬৫৫ |
৯০.৭২ |
১৪,৯৯১ |
৯৭.৪৯ |
১৪,১৫৩ |
১০০ |
৯,৩৬৪ |
যশোর |
৬৪.২৯ |
৯,৭৪৯ |
৬৯.৮৮ |
৮,১২২ |
৮৩.৯৫ |
১৮,৭০৩ |
৯৮.১১ |
২০,৮৭৮ |
১০০ |
১২,৮৯২ |
চট্টগ্রাম |
৭০.৩২ |
১০,২৬৯ |
৭৪.৪৫ |
৬,৩৩৯ |
৮০.৫০ |
১২,৬৭০ |
৮৯.৩৯ |
১৩,৭২০ |
১০০ |
১২,১৪৩ |
বরিশাল |
৮১.৮৫ |
৪,১৬৭ |
৮০.৬৫ |
৩,৯৯৩ |
৮৬.৯৫ |
৭,৩৮৬ |
৯৫.৭৬ |
৯,৯৭১ |
১০০ |
৫,৫৬৮ |
সিলেট |
৮৫.৩৯ |
৬,৬৯৮ |
৭১.৬২ |
১,৬৯৯ |
৮১.৪০ |
৪,৮৭১ |
৯৪.৮০ |
৪,৭৩১ |
১০০ |
৪,২৪২ |
দিনাজপুর |
৭৭.৫৬ |
১৪,২৯৫ |
৭৪.৪৮ |
৬,৪৫৯ |
৭৯.০৮ |
১১,৮৩০ |
৯২.৪৩ |
১৫,৩৪৯ |
১০০ |
১৪,৮৭১ |
ময়মনসিংহ |
৬৩.২২ |
৪,৮২৬ |
৭০.৪৪ |
৩,২৪৪ |
৮০.৩২ |
৫,০২৮ |
৯৫.৭১ |
৭,৬৮৭ |
১০০ |
১০,০৪০ |
মাদ্রাসা |
৯৩.৪০ |
৯,৬১৩ |
৯০.৭৫ |
৭,০৯৭ |
৯২.৫৬ |
৯,৪২৩ |
৯৫.৪৯ |
৪,৮৭২ |
১০০ |
৪,০৪৮ |
কারিগরি |
৮৮.০৯ |
৪,৯২২ |
৯১.২৫ |
৬,৯৭৭ |
৯৪.৪১ |
৭,১০৪ |
৯২.৮৫ |
৫,৭৭৫ |
১০০ |
৪,১৪৫ |
মোট |
৭৭.৭৮ |
১,৪৫,৯১১ |
৭৮.৬৪ |
৯২,৫৯৫ |
৮৫.৯৫ |
১,৭৬,২৮২ |
৯৫.২৬ |
১,৮৯,১৬৯ |
১০০ |
১,৬১,৮০৭ |
ফলাফল জানা যাবে যেভাবে : অন্যবারের মত এবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইটের পাশাপাশি যে কোনো মোবাইল থেকে এসএমএস করে উচ্চমাধ্যমিকের ফল জানা যাবে।
ঢাকা বোর্ডের ওয়েবসাইট (www.dhakaeducationboard.gov.bd) ও বোর্ডগুলোর সমন্বিত ওয়েবসাইটে (www.educationboardresults.gov.bd) ঢুকে রেজাল্ট কর্নারে ক্লিক করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এন্ট্রি সেরে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ফলাফল নামানো যাবে। এছাড়া পরীক্ষার্থীরা রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর টাইপ করে ফল জানতে পারবে।
ফল প্রকাশের পর মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমেও তা জানা যাবে।
এইচএসসির ফল জানতে HSC লিখে স্পেস দিয়ে শিক্ষা বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর লিখে স্পেস দিয়ে রোল নম্বর লিখে স্পেস দিয়ে 2024 লিখে 16222 নম্বরে পাঠাতে হবে। ফিরতি এসএমএসে আসবে ফল।
বিলম্বিত, বিড়ম্বিত : এ বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ৩০ জুন। তবে বন্যার কারণে সিলেট বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয় ৯ জুলাই। ১১ বোর্ডের অধীনে এবার প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসে।
এরপর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে ১৬ জুলাই রাতেই সারাদেশে স্কুল, কলেজ, পলিটেকনিকসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়।
পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেলে ১ অগাস্ট পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিকের সব পরীক্ষা স্থগিত করে আন্তঃশিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ৪ অগাস্ট থেকে পূর্বঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে সেই পরীক্ষাগুলোও স্থগিত হয়ে যায়।
বারবার স্থগিতের পর ১১ অগাস্ট থেকে নতুন সূচিতে পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর সহিংসতায় বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নপত্র পুড়ে গেলে পরীক্ষা ফের স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পরে স্থগিত পরীক্ষাগুলো ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেজন্য নতুন সূচিও প্রকাশ করেছিল কর্তৃপক্ষ; কিন্তু পরীক্ষা দিতে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে।
পরে অন্তর্বর্তী সরকার তা আরও দুই সপ্তাহ পিছিয়ে অর্ধেক প্রশ্নে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু ২০ অগাস্ট পাঁচ শতাধিক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ঢুকে পরীক্ষা না দেওয়ার দাবি তোলে। পরে সেদিনই সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে বাকি পরীক্ষাগুলো না নেওয়ার ঘোষণা দেয়।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :