ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনীতি বন্ধ রাখার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট সভায় গত সেপ্টেম্বর মাসে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সে সিদ্ধান্তের কোনো কার্যকারিতা এখন নেই বললেই চলে। ক্যাম্পাসে সক্রিয়ভাবেই রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে একাধিক ছাত্রসংগঠন। এ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
তারা বলছেন, এ বিষয়ে প্রশাসনের একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা উচিত।
অন্যদিকে ছাত্রনেতারা বলছেন, রাজনীতি করা তাদের সাংবিধানিক এবং নাগরিক অধিকার। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হতে পারে না, তবে সংস্কার হতে পারে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। পরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তের পর এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট।
এ ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম ধারার ছাত্রসংগঠনগুলো নিয়মিত তাদের কর্মসূচি পালন করছে। কয়েক বছর ধরে ছাত্রলীগের হামলা-নির্যাতনের কারণে ক্যাম্পাসে সশরীরে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও সরাসরি কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ৭ অক্টোবর প্রথমবার সংগঠনের ব্যানারে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলকে। বুয়েটশিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘নিরাপদ ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার’ গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাসের দাবিতে মৌন মিছিল করেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
শাখা সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস এবং সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের নেতৃত্বে মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে কার্জন হল, দোয়েল চত্বর হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
এরপর গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস উপলক্ষে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জগন্নাথ হলের অক্টোবর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ তাদের স্বাগত জানান বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ছাড়া ক্যাম্পাসে সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ফরম বিতরণের ঘোষণাও দেয় সংগঠনটি। নেতাকর্মীদের সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে গত সোমবার থেকে ১০ টাকা মূল্যের সদস্য ফরম বিতরণও শুরু করেছে ছাত্রদল। ক্যাম্পাসে সরাসরি ফরম বিতরণ এবং জমা নেবেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নুর আলম ভূঁইয়া ইমন।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে যারা সশরীরে ফরম নিয়ে জমা দিতে পারবেন না, তাদের অনলাইনে জমা নেওয়ার কথা জানায় সংগঠনটির নেতারা।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, ‘সিন্ডিকেট সভার সে সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি।
আমরা মনে করি, রাজনীতি করা আমাদের নাগরিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার খর্ব করার অধিকার কারও নেই। আমরা আমাদের সাংগঠনিক পন্থায় কর্মসূচি পালন করছি।’
তিনি বলেন, ঢাবির সিনেটের অধিকাংশ সিন্ডিকেট সদস্যরা আওয়ামী সমর্থক এবং তারা বিগত সময়ে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। তাদের নেওয়া সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক। তবে গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগ রাজনীতির নামে যে ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করেছে, সে ধরনের রাজনীতি কখনোই করবে না জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
অবশ্য ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে সদ্য প্রকাশ্যে আসা ছাত্রশিবিরে। সংগঠনটি এখনো পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সরাসরি কোনো কার্যক্রমে অংশ নেয়নি বা কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। গত ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদ স্মরণে দোয়া মাহফিল করলেও সেটি ছিল ক্যাম্পাসের বাইরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমরা চাই, রাজনীতির আদর্শে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপক ইতিবাচক সংস্কার হবে।
ভবিষ্যতের ছাত্ররাজনীতিতে মত-দ্বিমত হবে, যুক্তির পাথরে সবাই বিক্ষিপ্ত হবে, কিন্তু কোনো হকিস্টিক কিংবা স্ট্যাম্প থাকবে না। কোনো গেস্টরুম, গণরুম থাকবে না। চব্বিশের আকাক্সক্ষাকে বুকে নিয়ে এগিয়ে যাবে এই ছাত্ররাজনীতি। মধুতে ভিন্নমতের কেউ চা খেলে অন্যপক্ষের কেউ তেড়ে আসবে না। অ্যাকাডেমিক পরিবেশে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। আমরা মেধার ভিত্তিতে রাজনীতি করতে চাই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, ‘সভায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের রাজনীতি বন্ধের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি আকারে জানিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি কেন হয়নি আমার জানা নেই।’
ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ‘আমরা গত সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি। পরে আমরা বিজ্ঞপ্তি আকারে জানিয়ে দেব ভাবছিলাম।
তবে বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা আরেকটু সময় নিচ্ছি। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। আমাদেরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের আরেকটু সময় লাগবে। এরপর আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাব।’
এমটিআই